প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৩, ০৪:০৫
‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা সব ধরনের মানবাধিকারের চালিকাশক্তি’
আন্তর্জাতিক জরিপ ও হিসাব-নিকাশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা—এই শতকে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে। একইসঙ্গে আছে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা এবং নজরদারিও। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছে গোটা বিশ্ব। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা সব ধরনের মানবাধিকারের চালিকাশক্তি।’
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে ৫৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, মামলা, হুমকি ও পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাধার শিকার হয়েছেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে—জোরপূর্বক অপহরণ ও নিখোঁজ, রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে বাধা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে। আর বাকস্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিনের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত তিন বছরে ২০০-এর বেশি সাংবাদিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার শিকার হয়েছেন। এসব মামলায় অর্ধশত সাংবাদিককে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে দুটি জরুরি প্রশ্ন উত্থাপিত হতে দেখা যায়- মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা জরুরি কেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে গণমাধ্যমের করণীয় কী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন মনে করেন, পাঁচ কারণে মত প্রকাশের স্বাধীনতা জরুরি। প্রবল শক্তিশালীর বিরুদ্ধে লড়াই করার হাতিয়ার হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এটি সব পক্ষকে দায়িত্বশীল করে, ধর্মীয়-জাতিগত চিন্তা কিংবা লৈঙ্গিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সমানাধিকার নিশ্চিত করে এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে একটি অধিকতর ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠায় কাজ করে। তিনি বলেন, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর্টিকেল ১৯-এর মাধ্যমে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত। তাই অন্যান্য মানবাধিকার রক্ষার জন্য এই মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের কেন্দ্রীয় শক্তি।’
মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের করণীয় উল্লেখ করতে গিয়ে গ্লোবাল টেলিভিশন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম যে তথ্য বা কনটেন্ট উপস্থাপন করে, তার মালিকানা আসলে কার কাছে? সাংবাদিকের কাছে যিনি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন? নাকি গণমাধ্যম মালিকের কাছে? নাকি রাষ্ট্রের—যার ক্ষমতা তার কাছে? এসব জটিল প্রশ্নের নানা ধরনের উত্তর হবে। তবু বলতে হবে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়গ, গণমাধ্যমের মালিক ও রাষ্ট্রের মিলিত নেক্সাসের মধ্যে পড়েও জনগণের ভরসার এখনও শেষ ঠিকানা গণমাধ্যম।’
তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক অনেক প্রতিষ্ঠানের অকার্যকারিতায় বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কের, মত প্রকাশের সুযোগ করে দিচ্ছে গণমাধ্যমই এবং সেটা করছে সাংবাদিক সমাজ একটা লড়াইয়ে আছে বলেই। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বড় পুঁজির প্রবেশ ঘটেছে। একটা ঝা চকচকে অবস্থা অনেক দিন ধরে, অনেকের মাঝে দেখা গিয়েছে। কিন্তু তথাকথিত পুঁজি সাধারণ করপোরেট সংস্কৃতিও এই জগতে আনতে পারেনি। বাংলাদেশের খুব কম পত্রিকা, টেলিভিশন, বেতার বা অনলাইনের প্রাতিষ্ঠানিকতা দেখছি আমরা। গণমাধ্যমকর্মীদের রাজনৈতিক বিভাজন একটি বড় উদ্বেগের কারণ। সরকারের সহযোগিতায় এবং একই সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীদের নিজেদের উদ্যোগে গণমাধ্যমগুলো প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে না উঠলে, আমাদের সাংবাদিকতার মান বাড়বে না। আমাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে না। একইসঙ্গে আর্থিক অবস্থার কোনও বিকাশ দেখতে পাবো না নিকট ভবিষ্যতে।’
গণমাধ্যম পরিস্থিতি কেমন মুক্ত বা স্বাধীন, সে বিষয়ে বলতে গিয়ে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে গণমাধ্যম সংখ্যার দিক দিয়ে বিকশিত হয়েছে। এখানে প্রতিষ্ঠান ও মালিকের স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু সাংবাদিকতার স্বাধীনতা যদি বলি, সেটা ধারাবাহিকভাবে একই জায়গায় রয়ে গেছে।’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক হেনস্তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকের সংবাদ সংগ্রহকে ঘিরে যে আঘাতের সম্মুখীন হওয়ার ঘটনা বারবার ঘটছে, তা মুক্ত বা স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য প্রেক্ষাপট পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত করতে পেরেছে, বলা যাবে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক নির্যাতনের সুযোগ যে ধারাগুলোতে রয়েছে, সেগুলো সংশোধন বা বাতিলের দাবি আমরা শুরু থেকে জানিয়ে এলেও এখনও কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, সেটি হতাশার।’