প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২২, ০৩:৫২
বিজয়ের মাস শুরু
আজ থেকে শুরু হলো বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার স্বাক্ষর এই মাস। প্রতিবারের মতো এবারও মাসজুড়ে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হবে বাংলাদেশের বিজয়ের গল্প। কেননা, বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ঘটনা হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দক্ষ নেতৃত্বে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বপ্ন-সাধ পূরণ হয় এই মাসে।
৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় আসে এই মাসের ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীন জাতি হিসেবে সমগ্র বিশ্বে আত্মপরিচয় লাভ করে বাঙালিরা। নিজের ভূ-খণ্ড, আত্মপরিচয় আর সবুজের বুকে লাল সূর্য-খচিত নিজস্ব জাতীয় পতাকা হয়ে ওঠে সার্বভৌমত্বের প্রতীক। বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং তাঁর ডাকে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র জনযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর জাতির চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
এই বিজয় শুধু শুধু পেয়ে যাওয়া কোনও বিষয় নয়। কত শত মানুষ ঘরছাড়া হয়েছিল, জায়গা নিয়েছিল পাশের দেশের আশ্রয়কেন্দ্রে, সেই হিসাব নেই। দুই লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। যুদ্ধকালীন অপরাধে গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। ফলে বেদনাবিধুর এক শোকগাথার মাসও এই ডিসেম্বর।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ আর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের খবর চারদিক থেকে ভেসে আসতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
আত্মসমর্পণের আগের কয়েক দিন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর আল-শামসদের সহযোগিতায় হানাদার গোষ্ঠী দেশের মেধাবী, শ্রেষ্ঠ সন্তান-বুদ্ধিজীবীদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। সমগ্র জাতিকে মেধাহীন করে দেওয়ার এ ধরনের ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞের দ্বিতীয় কোনেও নজির বিশ্বে নেই।
এই অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল—তাদের বিচারে ১৯৭৩ সালের ১৯ জুলাই জাতীয় সংসদে ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট ১৯৭৩, অ্যাক্ট নং-এক্সআইএক্স অব ১৯৭৩, ২০ জুলাই ১৯৭৩’ পাস করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে এক বিচারহীনতার সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়। এরপর স্বৈরশাসকের আদেশে ‘কলাবরেটরস অ্যাক্ট’ বাতিল করা হয়। মুক্ত করে দেওয়া হয় সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন মামলার আসামিদের। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট অনুসারে ট্রাইব্যুনাল গঠন ও বিচারকাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ সময় পরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে প্রদত্ত অঙ্গীকার অনুযায়ী, মানবতাবিরোধীদের অপরাধের বিচারের জন্য ২৫ মার্চ ২০১০ সালে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর ৬ নম্বর অ্যাক্ট অনুযায়ী—একজনকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট বিচারপতির সমন্বয়ে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। একে একে বিচার সম্পন্ন হয় কুখ্যাত রাজাকার আলবদরের।
বিজয়ের মাসে আমাদের নতুন করে শপথ নেওয়ার বিষয় আছে উল্লেখ করে সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধ পরপর এসে আমাদের বিপর্যস্ত করতে চাইছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা সেসব মোকাবিলা করতে পারবো। সেটা করতে যে দেশপ্রেম থাকা দরকার, তার উৎস আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরদার করে এগিয়ে নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ সবাই আমাদের আশ্রয় দিতো, বিপদে আড়াল করে রাখতো। পারস্পরিক আস্থার জায়গা জিইয়ে রাখতে পারলে অসাধ্য সাধন সম্ভব।’