প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২২, ০১:০০
রাতের অন্ধকারে চলছে ইলিশ শিকার
সারা দেশে ইলিশ ধরার ওপরে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। সরকারি এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দেশের বিভিন্ন এলাকার নদীতে রাতের অন্ধকারে শত শত টন ইলিশ ধরছে একশ্রেণির দুর্বৃত্ত। স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে, আবার কোথাও কোথাও তাদের ম্যানেজ করে নদীতে চলছে ইলিশ ধরার মহোৎসব।
নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে রাতে নদীতে অভিযান পরিচালনা অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মুন্সীগঞ্জের পর ধলেশ্বরী থেকে শুরু করে পুরো মেঘনা নদী হয়ে বরিশালের মুলাদি এবং শিকারপুরের সন্ধ্যা নদীর মোহনা পর্যন্ত, অপরদিকে ভোলার তেঁতুলিয়া নদীতে রাতে শত শত ট্রলারে চলছে ইলিশ আহরণ। এসব নদীতে রাতের বেলায় চলাচলকারী একাধিক নৌযান চালকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই নিষেধাজ্ঞা চলবে আগামী ২৮ অক্টোবর মধ্যরাত পর্যন্ত। মা ইলিশকে স্বাচ্ছন্দ্যে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতেই এ সময়ে ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণে ‘প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ অ্যাক্ট, ১৯৫০’-এর অধীন প্রণীত ‘প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ রুলস, ১৯৮৫’ অনুযায়ী, সারা দেশে ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এসময় দেশব্যাপী ইলিশ আহরণ, বিপণন, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন, মজুত ও বিনিময় নিষিদ্ধ থাকবে। ইলিশ আহরণে বিরত থাকা সরকারিভাবে নিবন্ধিত জেলেদের সরকার খাদ্য সহায়তা হিসেবে দেবে ভিজিএফ চাল।
কিন্তু সরকারের এতসব উদ্যোগের পরেও রাতের অন্ধকারে দেশের মেঘনাসহ বিভিন্ন এলাকার নদীতে চলছে ইলিশ শিকার। দিনের বেলা নদীতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হলেও রাতে নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসন কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে নদীতে যায় না। এই সুযোগেই শত শত জেলে নৌকা নিয়ে ইলিশ শিকার করছে। ধরছে মা ইলিশ। ঢাকা থেকে নৌপথে বরিশাল ও ভোলা আসা-যাওয়ার পথে এ দৃশ্য দেখা গেছে।
বিভিন্ন রুটে নৌযান পরিচালনাকারী সদস্যরা জানিয়েছেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা- উপজেলা থেকে ঢাকার দিকে ছেড়ে আসা এবং ঢাকা থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলো মুন্সীগঞ্জের পর থেকে নদীতে স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারে না। রাতে নদীতে জাল ফেলে জেলেরা নৌকায় বা ট্রলারে অবস্থান করেন। কোনও নৌযানকে তাদের জালের কাছাকাছি দিয়ে আসতে দেখা মাত্রই নৌকা থেকে উচ্চ আলো ছড়াতে সক্ষম টর্চলাইট দিয়ে দিক পরিবর্তনের নির্দেশনা দেয়। লঞ্চগুলোর চালকরা এসব টর্চের আলোতে দেখানো নির্দেশনা অনুযায়ী দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে জাল ফেলা এলাকা অতিক্রম করে। এটি এখন মেঘনা অববাহিকা সংলগ্ন নদীগুলোর রাতের স্বাভাবিক দৃশ্য।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান জানিয়েছেন, এমন অভিযোগ এখন পর্যন্ত তার কাছে আসেনি। তবে শুরু থেকেই গত দুদিন দিনে এবং রাতে নৌপুলিশের পাশাপাশি আনসার কোস্টগার্ড নিয়মিত টহল দিচ্ছে। এদের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতে কোনও দুর্বৃত্ত নদীতে ইলিশ মাছ ধরছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হবে। যদি এমন কোনও ঘটনা ঘটে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে ভোলার জেলা প্রশাসক মো. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব নয়।’ এ বিষয়ে যেকোনও তথ্যের জন্য জেলার মৎস্য কর্মকর্তার কাছে খোঁজ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
অপরদিকে মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুল বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এমন ঘটনা কানে আসেনি। তবে অবশ্যই খোঁজ নিচ্ছি। দিনে-রাতেই নদীতে টহল দেওয়া হচ্ছে। মা ইলিশ রক্ষায় নদীতে অভিযান পরিচালনায় মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম চলছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেঘনা নদীর তীর লাগোয়া ১০টি স্থানে ও ভোলার ইলিশা বন্দরের পাড় ঘেঁষে রাত গভীর হলেই জমে ওঠে অবৈধভাবে ধরা এসব ইলিশের হাট। এসব হাটেই রাতের বেলায় ধরা ইলিশ বিক্রি হয়ে যায়। ট্রলারে করে এসে এসব হাট থেকে ইলিশ কিনে নিয়ে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করছেন তারা। আবার কেউ কেউ সংরক্ষণ করছেন। মাত্র তো কয়েকটা দিন। এর পরেই তো এসব মাছ প্রকাশ্যে বিক্রি হবে, যখন নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। দিনে প্রশাসনের নজরদারি এড়াতে রাতই অনেকটা নিরাপদ মনে করছেন তারা। প্রতি বছরের মতো এবারও স্থানীয় প্রশাসন মা ইলিশ শিকারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু ঠেকানো যাচ্ছে না ইলিশ নিধন কার্যক্রম। কেজির পরিবর্তে হালি ধরে বিক্রি হচ্ছে এসব ইলিশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোলার একজন জেলে জানিয়েছেন, মাছ ব্যবসায়ীরা এ সময় জেলেদের নদীতে জাল ফেলতে বাধ্য করেন। ধরা পড়া মাছের দাম বেশি দেওয়ারও লোভ দেখানো হয়। জেলেরা এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেন। তাই ব্যবসায়ীদের অবৈধ নির্দেশ অমান্য করতে পারেন না জেলেরা। এ কাজে প্রশাসনের কেউ কেউ অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। যদিও তাদের বিষয়ে কেউ মুখ খোলেন না।
জানতে চাইলে ঢাকা থেকে পটুয়াখালীগামী এম ভি পূবালী লঞ্চের চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রাতের বেলা নদীতে মাছ ধরতে দেখায় আমরা রীতিমতো অভ্যস্ত। কারণ, আমরা রাতেই নদীতে থাকি। জেলেরা নদীতে জাল ফেলে নৌকা বা ট্রলারেই বসে থাকেন। লঞ্চ দেখা মাত্র ওইসব নৌকা, ট্রলার এবং জাল এড়িয়ে যাওয়ার জন্য তারা উচ্চ পাওয়ারের টর্চলাইট মারে। আমরা তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী জাল ও ট্রলার এড়িয়েই লঞ্চ চালাই।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার আগে-পরে মিলিয়ে মোট ১৫ থেকে ১৭ দিন ইলিশের ডিম ছাড়ার প্রধান মৌসুম মনে করা হলেও এখন সময় আরও বাড়িয়েছে সরকার। গবেষকদের মতে, ইলিশ শুধু আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমায় নয়, অমাবস্যায়ও ডিম ছাড়ে। সে কারণে সময় বাড়িয়ে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়িয়ে ২২ দিন করা হয়েছে। এ সময় সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মা ইলিশ ছুটে আসে নদীতে। ফলে মা-ইলিশের প্রজনন নির্বিঘ্ন রাখতে প্রতিবছর তিন সপ্তাহ ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করে সরকার। সে কারণেই সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, এ বছর ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
উল্লেখ্য, ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণে ‘প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ অ্যাক্ট, ১৯৫০’-এর অধীন প্রণীত ‘প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ রুলস, ১৯৮৫’ অনুযায়ী, মোট ২২ দিন সারা দেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুত ও বিপণন নিষিদ্ধ। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করা হলে আইনে কমপক্ষে এক থেকে সর্বোচ্চ দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত বছর (২০২১ সাল) দেশের অভ্যন্তরীণ সমুদ্র ও উপকূলীয় এলাকা এবং নদ-নদীতে মা-ইলিশ রক্ষায় সিভিল প্রশাসনের পাশাপাশি কাজ করেছে নৌবাহিনীর জাহাজ। এবারও এসব জাহাজ অভিযানের অংশ হিসেবে সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার ও কুতুবদিয়া অঞ্চলে বিশেষ টহল দিচ্ছে।