প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৬:১৯
প্রচণ্ড চাপের মুখে বাংলাদেশের অর্থনীতি : এপির প্রতিবেদন
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ‘মিরাকল অর্থনীতি’ প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছে। যার ফলে প্রতিবাদ বিক্ষোভও হয়েছে। এতে সরকারের ওপরও চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। ওদিকে দেশের অর্থনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফের কাছে সহায়তা চেয়েছে সরকার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ পরিস্থিতি শ্রীলংকার মতো ভয়াবহ নয়। কয়েক মাসের প্রতিবাদ বিক্ষোভ, অস্থিরতার পর শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে পালিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হন। সেখানে এখনও খাদ্য, জ্বালানি এবং মেডিসিনের তীব্র সংকট। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি তেমন না হলেও একই রকম সমস্যার মুখে রয়েছে দেশটি। উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন প্রকল্পে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। এসব প্রকল্পে দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি নিয়ে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। বাণিজ্যিক ভারসাম্য দুর্বল হয়ে পড়েছে। এসব প্রবণতা বাংলাদেশের বিস্ময়কর অগ্রগতিকে খর্ব করছে।
গত মাসে সরকার জ্বালানির মূল্য শতকরা কমপক্ষে ৫০ ভাগ বাড়ায়। এর ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিপত্রের দামও বেড়ে যায়। প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়। সরকার চাল ও অন্যান্য জিনিস সরকার নিয়োজিত ডিলারদের ভর্তুকিমূল্যে বিক্রির নির্দেশ দেয়।
সর্বশেষ এই কর্মসূচি চালু হয় ১লা সেপ্টেম্বর। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী বলেছেন, এতে প্রায় ৫ কোটি মানুষ উপকৃত হবেন। তিনি আরও বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষদের চাপ কমাতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। যা বাজারের ওপর প্রভাব ফেলবে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমবে।
ঢাকাভিত্তিক পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের অর্থনীতিবিদ এবং পরিচালক আহমেদ আহসান বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি তীব্র প্রতিকূলতা এবং অস্থিরতার মুখোমুখি হয়েছে। আকস্মিকভাবে আমরা বিদ্যুৎসংকটের যুগে ফিরে গিয়েছি। বিদেশি রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে। নিম্ন আয়ের লাখো বাংলাদেশি মাসে একবার মাছ বা মাংসের সংস্থান করতে পারছে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অবদান গার্মেন্ট খাতের। এর ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ এগিয়ে যায় মধ্যম আয়ের দেশের দিকে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যের বিরুদ্ধ লড়াইয়ে গত দুই দশকে ব্যাপক উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। গার্মেন্ট শিল্পে বিনিয়োগের ফলে লাখো মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এর বেশির ভাগই নারী। বাংলাদেশে মোট রপ্তানির মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগের বেশি তৈরি পোশাক ও সংশ্লিষ্ট পণ্য। কিন্তু জ্বালানির উচ্চ মূল্যের কারণে কর্তৃপক্ষ ডিজেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। মোট উৎপাদনের শতকরা কমপক্ষে ৬ ভাগ এসব বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে আসতো। এর ফলে প্রতিদিন ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কম উৎপাদন হচ্ছে। এতে কারখানায় উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটছে।
২০২২ সালের জুনে শেষ হওয়া অর্থ বছরে আমদানি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪০০ কোটি ডলার। আর রপ্তানি কমেছে। বর্তমানে রেকর্ড ১৭০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি আছে।
সামনে আরও চ্যালেঞ্জ
কমপক্ষে ২০টি মেগা অবকাঠামোগত প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ডেডলাইন দ্রুত সামনে এগিয়ে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে চীন নির্মিত ৩৬০ কোটি ডলারের পদ্মাসেতু, পারমাণবিক শক্তি চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার প্রায় পুরোটাই অর্থায়ন করেছে রাশিয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৪ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে এসব প্রকল্পের অর্থ পরিশোধের শিডিউল এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুতি নেয়া উচিত বাংলাদেশের। জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। একে অর্থনীতিবিদরা পূর্ব সতর্কতা হিসেবে দেখছেন। শ্রীলংকা এবং পাকিস্তানের পর দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই সহায়তা চেয়েছে।
অর্থমন্ত্রী এএইচএম মুস্তাফা কামাল বলেছেন, ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্টস এবং বাজেটারি অ্যাসিসট্যান্স’ হিসেবে ঋণের জন্য আইএমএফের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেছে সরকার। আইএমএফ বলেছে, তারা বাংলাদেশের জন্য পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভ পড়ে যাচ্ছে। কার্যত এতে ওইসব ঋণ শোধের যে বাধ্যবাধকতা সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামর্থ খর্ব হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, বুধবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬৯০ কোটি ডলারে। এক বছর আগে এর পরিমাণ ছিল ৪৫৫০ কোটি ডলার।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অতিরিক্ত খরচের কিছু প্রকল্প সত্ত্বেও এ অঞ্চলে অন্য অনেক দেশের চেয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট ভাল অবস্থায় আছে বাংলাদেশ। এর আছে ফার্ম সেক্টর- যেমন চা, চাল, পাট হলো বড় রপ্তানি পণ্য। অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে পারে এসব সেক্টর। এর অর্থনীতি শ্রীলংকার চেয়ে চার থেকে পাঁচ গুন বেশি। ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পর্যটন খাতে ধস নামলে বিপন্ন হওয়ার মতো অবস্থায় নেই।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী, এই অর্থ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শতকরা ৬.৬ ভাগ প্রবৃদ্ধি হবে। আর দেশটির মোট ঋণ তুলনামুলকভাবে কম। শ্রীলংকা এবং বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবধান হলো ঋণের বোঝা। বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণ। জাতীয় প্রবৃদ্ধির শতকরা ২০ ভাগের নিচে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ। আর ২০২২ সালের প্রথম চতুর্ভাগে এর পরিমাণ শ্রীলংকায় ছিল শতকরা প্রায় ১২৬ ভাগ।