প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২২, ০৭:৪৬
টিপু হত্যায় রাজনৈতিক মোড়
মতিঝিলের আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুসহ ডাবল মার্ডারের ঘটনায় নতুন সমীকরণ সামনে এসেছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে মনে করা হলেও তদন্তে নিয়েছে রাজনৈতিক মোড়।
গত দুই দিনে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যে ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের একজন ছাড়া বাকিরা মতিঝিলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। অনেকেই আগে থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে ছিলেন।
এদিকে স্থানীয় নেতাকর্মীদের অনেকের ভাষ্যে, মতিঝিলে যে দুই-একজনের রাজনৈতিক ভবিষ্যত ছিল, এই হত্যাকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। এতে কারাবন্দি সাবেক দুই নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও খালেদের ‘পথ পরিষ্কার’ হয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা তাদের।
টিপু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত শনিবার (৩১ জুলাই) ও রবিবার রাতে নতুন করে ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন— মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সেক্রেটারি সোহেল শাহরিয়ার, ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মারুফ রেজা সাগর, একই ওয়ার্ডের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আরিফুর রহমান সোহেল ওরফে ঘাতক সোহেল, মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান টিটু, মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক খায়রুল আলম ও মতিঝিল থানা জাতীয় পার্টির সভাপতি জুবায়ের আলম খান রবিন।
সোহেল ও সাগরকে সোমবার তিন দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। এর আগে রবিবার বাকি চার জনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ জানান, ‘এটি স্পর্শকাতর ঘটনা। জড়িত অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে। পারিপার্শ্বিকতা, স্বাক্ষ্যপ্রমাণ ও কথা বলে যাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি তাদের গ্রেফতার করেছি।’
ডিবির এই কর্মকর্তা আরও জানান, টিপু হত্যায় এর আগে গ্রেফতার হওয়া সুমন শিকদার ওরফে মুসা আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। সেটার ভিত্তিতেই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে টিপু হত্যায় কার কী ভূমিকা ছিল তা তদন্ত করে দেখা হবে।’
গত ২৪ মার্চ রাত সোয়া ১০টার দিকে ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা শাহজাহানপুর আমতলা এলাকায় নিজ গাড়িতে বাসায় ফেরার সময় এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করা হয় জাহিদুল ইসলাম টিপুকে। এসময় যানজটে রিকশায় থাকা সামিয়া আফনান নামে এক কলেজ শিক্ষার্থীও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
আলোচিত এই জোড়া খুনের দুই দিনের মাথায় শুটার মাসুমকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশের খিলগাঁও জোনাল টিম। হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় মাসুম। মাসুমের স্বীকারোক্তিতে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় উঠে আসে অনেকের নাম।
শুটার মাসুমকে হত্যার নির্দেশনা দানকারী মুসাকে ওমান থেকে ফিরিয়ে আনে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের আগেই দুবাই চলে যান মুসা।
গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, টিপু হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার পর মোল্লা শামীমকে দায়িত্ব দিয়ে গত ১২ মার্চ দুবাই চলে যান মুসা। হত্যাকাণ্ডের পর তদন্তে নাম এলে দুবাই থেকে ফের পালিয়ে ওমান চলে যান। ওমানে গিয়ে মতিঝিলের আওয়ামী লীগ নেতা ক্যাসিনো সাঈদের কাছে আশ্রয় নেন তিনি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মুসার পাসপোর্ট সংগ্রহ করে পুলিশ সদর দফতরের এনসিবি শাখার মাধ্যমে রয়েল পুলিশ অব ওমানের এনসিবি শাখাকে চিঠির মাধ্যমে মুসাকে গ্রেফতারে সহযোগিতা চায়। বাংলাদেশ পুলিশের অনুরোধে গত ১৭ মে রয়েল পুলিশ অব ওমান মুসাকে আটক করে।
পরে পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি টিম ওমানে গিয়ে ৯ মে মুসাকে দেশে ফিরিয়ে আনে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, দেশে ফিরিয়ে আনার পর মুসাকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মুসা অনেকের নাম বলে। সেই সূত্রে ধরে গত শনিবার ও রবিবার গ্রেফতার করা হয় ছয় জন।
মুসার জবানবন্দিতে আরও দুজন আওয়ামী লীগ নেতার নাম রয়েছে। তাদের একজন মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। আরেকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর বলেও জানা গেছে।
তদন্ত ও স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া জাতীয় পার্টির নেতা জুবায়ের আলম রবিন কমলাপুর এলাকার প্রগতি সংঘের সভাপতি। টিপুকে হত্যার আগে ওই ক্লাবেই বৈঠক হয়েছিল।
এছাড়া রবিনের বিরুদ্ধে ’৮৮ সাল থেকেই হত্যা, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ রয়েছে। ১৯৮৮ সালে প্রথম পনির হত্যা মামলায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু তখন জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকায় পার পেয়ে যান তিনি।
এছাড়ার তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে পলাশ, মুন্নাসহ একাধিক মার্ডারের ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। জাতীয় পার্টির রাজনীতি করলেও রবিনের সঙ্গে মতিঝিল এলাকার এক সময়ের দাপুটে নেতা তারেক ও রিয়াজ উদ্দিন মিল্কির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তারেকের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়।
মতিঝিল এলাকার সাবেক দুই নেতার মধ্যে দূরত্ব তৈরিতেও ভূমিকা রাখেন রবিন। এছাড়া তার সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া সাগরসহ আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও ফ্রিডম মানিকেরও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রেফতার হওয়া সাগর ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি। তিনি মতিঝিল এলাকার সাবেক নেতা ও ২০১৩ সালে গুলশানে খুন হওয়া রিয়াজ উদ্দিন মিল্কির হাত ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। একসময় তিনি রিয়াজের গাড়িচালক ও সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের ভর্তি বাণিজ্যে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এই সাগরের স্ত্রী লোপার মাধ্যমে তথ্য পেয়েই মিল্কির অবস্থান জেনে তাকে খুন করা হয়।
ওই মামলায় সাগরের স্ত্রী আদালত থেকে জামিন নিয়ে বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। সাগরকে এর আগে র্যাব একবার অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছিল। মতিঝিলে বাবু হত্যার ঘটনায়ও তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, গ্রেফতার হওয়া আরিফুর রহমান সোহেল ওরফে ঘাতক সোহেল ১০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়কও ছিলেন তিনি।
নটরডেম কলেজের বিপরীত দিকের ইডেন কমপ্লেক্স এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। টিপু হত্যাকাণ্ডে কিলার মাসুমের মোটরসাইকেলের চালক হিসেবে থাকা মোল্লা শামীম ছিলেন এই সোহেলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও মানিকের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।
এছাড়া গ্রেফতার হওয়া আরেকজন মাহবুবুর রহমান টিটু মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মনসুরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী তিনি। মতিঝিলের কলোনি কাঁচাবাজার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। তার সঙ্গেও আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও মানিকের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, গ্রেফতার হওয়া খায়রুলও ঘাতক সোহেলের সঙ্গে মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। কারাবন্দি সাবেক যুবলীগ নেতা খালিদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিল খায়রুল। চলাফেরা করতেন সাগরের সঙ্গে। দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও মানিকের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল তার। এছাড়া মতিঝিলের বিএডিসি ভবনের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
গ্রেফতার হওয়া সোহেল শাহরিয়ার ছিলেন মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। দীর্ঘদিন কানাডায় থেকে বছর দেড়েক আগে দেশে ফেরেন। যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। তার সঙ্গেও মানিক ও জিসানের যোগাযোগ রয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, গ্রেফতার হওয়া সবাই টিপু হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি জানতেন। মতিঝিল এলাকার আধিপত্য, টেন্ডারবাজি ও রাজনৈতিক পদ-পদবী নিয়ন্ত্রণের জন্য টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তারা। নেপথ্যে থেকে পুরো হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করে পলাতক দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও মানিক।
এদিকে মতিঝিল এলাকার স্থানীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, টিপু হত্যাকাণ্ডে দুই-একজনের সম্পৃক্ততার ঘটনাটি উদ্দেশ্য-প্রণোদিত বলে তাদের মনে হয়েছে। কারণ মতিঝিল এলাকার যুবলীগের দুই শীর্ষ নেতা সম্রাট ও খালিদ কারাগারে যাওয়ায় এই পদ পাওয়ার চেষ্টা করছিল অনেকেই। পদগুলো যাতে হাতছাড়া না হয় এজন্য যাদের রাজনৈতিক সম্ভাবনা ছিল তাদের হত্যা মামলায় জড়িয়ে দমনের চেষ্টা চলছে বলে দাবি তাদের।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন