প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২২, ১৩:১০
ফিরতি পথেও স্বাচ্ছন্দ্যে ২১ জেলার মানুষ
দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের এবারের ঈদযাত্রা এবং ঈদ শেষে ঢাকা ফেরা ছিল স্বাচ্ছন্দ্যের। বিগত বছরগুলোতে যানজট আর ফেরির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে ঘাটে। কিন্তু এবার পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর সেই চিত্র পালটে গেছে। ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়ে পদ্মা সেতু পার হয়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টায় পৌঁছানো গেছে বরিশাল বা খুলনায়। তেমনি ঈদের পর ফিরতি পথেও এরকম কম সময় লেগেছে।
দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তা প্রধান দীপ আজাদ। তিনি তার ফেসবুক পেজে লেখেন, ‘পদ্মা সেতু, খুলনার টুটপাড়া থেকে মাত্র ৩ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটে ঢাকার গ্রিন রোড।’
ফোনে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব এ সাংবাদিক নেতা বলেন, ‘বিষয়টি ছিল স্বপ্নের মতো। মঙ্গলবার ১২ জুলাই দুপুর ২টায় খুলনার টুটপাড়া থেকে সড়কপথে রওয়ানা হই ঢাকার উদ্দেশে। পদ্মা সেতু পার হয়ে সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় পৌঁছে যাই গ্রিন রোডের বাসায়। অথচ পদ্মা সেতু হওয়ার আগে পুরোপুরি অনিশ্চিত ছিল এ পথের যাত্রা। ফেরি চেপে পদ্মা পাড়ি দিয়ে খুলনা থেকে আসতে লেগে যেত ১৫-১৬ ঘণ্টা। এক পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা যে কতটা পালটে দিয়েছে তা জানে শুধু এ অঞ্চলের মানুষ।’
সড়ক যোগাযোগ প্রশ্নে দীপ আজাদের মতোই সুখস্বপ্নে ভাসছেন বরিশাল ও খুলনার মানুষ। পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে কোনোরকম কষ্টই হচ্ছে না কারও। তার ওপর রয়েছে আগের চেয়ে ৬-৮ ঘণ্টা কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর সুবিধা। এসব কারণে এবার ঈদের আনন্দজুড়েও ছিল পদ্মা সেতুর আলোচনা।
নেক্সাস টেলিভিশনের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর আমিন আল রশিদ বলেন, ‘ঈদের আগের দিন ঢাকার পান্থপথ থেকে গ্রিন লাইন বাসে উঠি গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠী যাওয়ার উদ্দেশে। পথে একবার গাড়ি বিকল হয়। তাছাড়া পান্থপথ থেকে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে পৌঁছতে লেগে যায় ১ ঘণ্টা। এ দেড় ঘণ্টা বাদ দিলেও মোটামুটি পৌনে ৪ ঘণ্টায় পৌঁছেছি বরিশালের রূপাতলী বাস টার্মিনালে। যেটা এক সময় ছিল স্বপ্নের মতো। সেই স্বপ্নই সত্যি করেছে পদ্মা সেতু।’
এবারের ঈদে ঢাকা-বরিশাল রুটে লঞ্চের স্পেশাল সার্ভিস চলেছে একদিন। ঢাকা থেকে সরাসরি সার্ভিসের ১০টি লঞ্চ ছাদ পর্যন্ত বোঝাই যাত্রী নিয়ে ৮ জুলাই শুক্রবার আসে বরিশালে। এর আগে-পরে আর চলেনি ঈদকেন্দ্রিক কোনো বিশেষ সার্ভিস। অবশ্য এ ১০ লঞ্চের আসাকেও স্পেশাল হিসাবে মানতে নারাজ অনেকে।
বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঈদের আগে-পরে টানা ১০ দিন চলত স্পেশাল সার্ভিস। এ সময়ে ১৮-২০টি লঞ্চ যাত্রী আনা-নেওয়া করত উভয়প্রান্তে। সেভাবে দেখলে এ ১০ লঞ্চের মাত্র একদিন যাত্রী বোঝাই হয়ে আসা কোনোভাবেই স্পেশাল সার্ভিস হতে পারে না। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ঈদযাত্রার চাপ বেশিরভাগই পড়েছে সড়কে। ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি ঢাকা থেকে বরিশাল কিংবা খুলনায় পৌঁছে যাওয়া যায় তবে লঞ্চে গোপাল গাদানী কিংবা কেবিনের জন্য হাহাকার কেন করবে মানুষ?’
ঈদ পরবর্তী ফিরতি যাত্রায়ও একই পরিস্থিতি ঢাকামুখী সড়ক ও নৌপথে। সোমবার থেকেই চাপ বাড়তে শুরু করে মহাসড়কে। সময়সূচি ভেঙে যাত্রী হলেই বরিশাল ছেড়ে যাচ্ছে ঢাকামুখী বাস। এরপরও বাসের টিকিটের জন্য কাউন্টারগুলোর সামনে ভিড় থাকছে মানুষের।
বরিশাল জেলা বাস মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার দে বলেন, ‘সড়কপথে ঢাকামুখী মানুষের এত চাপ এর আগে আর কখনোই দেখিনি। সবাই পদ্মা সেতু হয়ে কম সময়ে ছুটছেন ঢাকায়। এখন পর্যন্ত তেমন কোনো জটিলতাও হয়নি। ঈদের আগে পদ্মা সেতু এবং ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেস সড়কের টোলে যে যানজট হয়েছিল তেমন কোনো সমস্যাও গত দুদিনে হয়নি।’
বুধবার ঢাকায় যাওয়ার উদ্দেশে বরিশালের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে আসা জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার অফিস কমলাপুরে। বেলা ১১টার মধ্যে অফিসে ঢুকলেও হবে। তাই এসেছি বাসে ঢাকা যেতে। ৩ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছাতে পারলেও ১১টায় অফিসে ঢুকতে পারব।’
এনজিওকর্মী মনসুরা বেগম বলেন, ‘ঈদের একদিন আগে বাসে ঢাকা থেকে এসেছি। ঘণ্টা তিনেক লেগেছে। আজ আবার ঢাকায় ফিরছি। আশা করি ৩ ঘণ্টার বেশি লাগবে না। আমার পরিচিত যারা ঢাকায় চাকরি করেন তাদের প্রায় সবাই এবার পদ্মা সেতু পার হয়ে সড়কপথে এসেছে। ফিরবেনও একই পথে। ঈদে যে কদিন বাড়িতে ছিলাম তার প্রায় অনেকটা সময় এ সেতু নিয়েই আলোচনা হয়েছে। সেতু হওয়ায় সবাই খুশি। আগে যেখানে পদ্মা পাড়ি দিয়ে বরিশালে আসতে দিন পার হয়ে যেত সেখানে এখন মাত্র ৩ ঘণ্টায় পৌঁছে যাচ্ছি ঢাকায়। এরচেয়ে বড় আনন্দ আর কি হতে পারে?’
সড়কপথে ভিড় বাড়ার পাশাপাশি বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়েরও অভিযোগ উঠেছে। পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-বরিশাল রুটে চলা নন-এসি বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ৪৫৬ হলেও অধিকাংশ পরিবহণ যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করছে ৫শ থেকে ৬শ টাকা পর্যন্ত। একমাত্র সাকুরা পরিবহণ ছাড়া অন্য প্রায় সব পরিবহণের ক্ষেত্রে লক্ষ করা গেছে বাড়তি ভাড়া আদায়ের প্রবণতা।
বরিশালের নথুলাবাদ বাস টার্মিনালে থাকা বেশ কয়েকটি বাসের কাউন্টারে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, ‘বরিশাল থেকে বিপুল যাত্রী হলেও ঢাকা থেকে তেমন একটা যাত্রী আসছে না। বাসগুলো খালি চালিয়ে ফিরতে হচ্ছে। তাই লোকসান পোষাতে খানিকটা বেশি ভাড়া নিচ্ছি আমরা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলেই আবার আগের রেটে শুরু হবে ভাড়া আদায়।’
পদ্মা সেতুর কল্যাণে সড়কপথে যতটা ভিড় ঠিক তার উলটো চিত্র নৌপথে। ঈদ পরবর্তী যাত্রীর ভিড় সামলাতে মঙ্গলবার ১২ জুলাই রাতে বরিশাল লঞ্চঘাটে রাখা হয় ঢাকাগামী ১১টি বিলাসবহুল লঞ্চ। কিন্তু শেষপর্যন্ত যাত্রীর চাপ খুব একটা বেশি না হওয়ায় ৩টি লঞ্চ সরিয়ে নেওয়া হয় সার্ভিস থেকে।
বরিশাল নদীবন্দরের নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের পরিদর্শক কবির হোসেন বলেন, ‘লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ সামলাতে সবরকম ব্যবস্থা ছিল আমাদের। কিন্তু শেষপর্যন্ত তেমন একটা ভিড় না হওয়ায় সমস্যা হয়নি। নিয়মিত সার্ভিসের ৮টি লঞ্চই ছেড়ে গেছে ঢাকার উদ্দেশে।
বরিশাল থেকে ঢাকা যাওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পিয়াল চৌধুরী বলেন, ‘ঘাটে আসার পর ঢাকাগামী লঞ্চের কেবিন পেয়েছি। যেটা আগেকার যে কোনো ঈদে ছিল অসম্ভব। সবই পদ্মা সেতুর কল্যাণে।’ কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সহসভাপতি সাঈদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার লঞ্চে চাপ বাড়বে বলে আমরা আশা করছি। কেননা ঈদের পর প্রথম ২-১ দিন আগেও তেমন একটা চাপ থাকত না।’ অবশ্য তিনি স্বীকার করেন যে, পদ্মা সেতুর কারণে লঞ্চের যাত্রী আগের তুলনায় বেশ কমেছে।’
ঈদ পরবর্তী যাত্রীর চাপ নেই ঢাকা-বরিশাল রুটের আকাশপথেও। আগে প্রতি ঈদে অতিরিক্ত ফ্লাইট দেওয়ার পাশাপাশি আকাশচুম্বী হয়ে যেত বিমানের ভাড়া। কিন্তু এবার তেমনটা হয়নি। রাজধানীর ব্যবসায়ী বরিশালের বাসিন্দা জাকির আজাদ বলেন, ‘আগে পরিবার নিয়ে বিমানেই আসতাম। এবার ঈদে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে পদ্মা সেতু পার হয়ে বরিশালে এসেছি। যাবও সড়কপথে।’ এমনি আরও অনেকেই এবার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে সড়কপথে চলে এসেছেন বরিশাল ও খুলনার বিভিন্ন এলাকায় ঈদ করতে। যাদের বড় একটি অংশ আগে ঈদে আসতেন আকাশপথে।
বরিশাল বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক আব্দুর রহিম তালুকদার বলেন, ‘আগে ঈদে অতিরিক্ত ফ্লাইট দিত বিমান, ইউএস বাংলা এবং নভোএয়ার। কিন্তু এবার ঈদের আগে-পরে কোনো বিমান সংস্থারই বাড়তি ফ্লাইট ছিল না। নিয়মিত ফ্লাইটেই ঢাকা-বরিশাল রুটে যাওয়া-আসা করছেন যাত্রীরা।’
সূত্র: যুগান্তর