রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে

প্রকাশ : ২১ জুন ২০২২, ১১:১১

বন্যার মূল কারণ অতিবৃষ্টি, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলেও শঙ্কা

বন্যার মূল কারণ অতিবৃষ্টি, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলেও শঙ্কা
অনলাইন ডেস্ক

দেশের পূর্ব এবং উত্তরাঞ্চলে বর্তমান বন্যার মূল কারণ অতিবৃষ্টি। দেশের ভেতরে যেমন রেকর্ড বৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি এই বানের পানির আরেক উৎস ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতেও অতি ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। এই উভয় ক্ষেত্রেই বর্ষণ অতীতের রেকর্ড ভেঙেছে।

এর মধ্যে ভারতের মেঘালয়ে ১২২ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে এবারের বৃষ্টি। আর সিলেটে রোববার যে বৃষ্টি হয়েছে তা গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূলত হাওড় যেমন এই বাড়তি পানি ধারণ করতে পারেনি, তেমনি মেঘনা অববাহিকার নদ-নদীগুলোও তা নিষ্কাশন করতে পারেনি। ফলে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াল বন্যার। যা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে, কোনো কোনো নদীতে পানির উচ্চতা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। এর মধ্যে সিলেট অঞ্চলের প্রধান নদী সুরমা সুনামগঞ্জের দিরাই পয়েন্টে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। এর আগে এই পয়েন্টে পানির সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ৭.২৯ মিটার। কিন্তু রোববার ও সোমবার পরপর দুদিনই এর ওপরে প্রবাহিত হয়েছিল। প্রথম দিন এটি প্রবাহিত হয় ৭.৬৩ মিটারে আর সোমবার ৭.৪৭ মিটার।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, এই ভয়াবহ বন্যার মূল কারণ হলো অতিবৃষ্টি। দেশের পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলে যথাক্রমে বরাক ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পানি প্রবাহিত হয়। এর অতিরিক্ত পূর্বাঞ্চলেও পাহাড়ি ঢলের পানি আসে। উল্লিখিত দুই অববাহিকায়ই এবার প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে চেরাপুঞ্জিতে ১৭ জুন ১২২ বছরের রেকর্ড ভেঙে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এমন বৃষ্টি মেঘালয়ে গত কয়েকদিন ধরেই হচ্ছে। আসামেও ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে সিলেটে রোববার ৩০৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এর আগে ২০০১ সাল থেকে এত বৃষ্টি হয়নি এই এলাকায়। উজানের ঢল আর দেশের ভেতরের-বাইরের অতিবৃষ্টিতেই সিলেট বিভাগে এত ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে।

এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই অতি ভারি বৃষ্টির অন্যতম কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে জলবায়ুর স্বাভাবিক ধারা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। যে কারণে অল্প সময়ে শতবর্ষের রেকর্ড ভাঙা বৃষ্টি হচ্ছে। আবার যখন খরা দেয় তখনো ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হয়। তবে সিলেট অঞ্চলের এই বন্যার জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নকে বেশি দায়ী করা যায় না। কেননা কিশোরগঞ্জের যে সড়ককে এখন দায়ী করা হচ্ছে সেখান থেকে সিলেট আর সুনামগঞ্জ অনেক ওপরে। বরং নদীর নাব্য, বাঁধ আর আবহাওয়ার বিশেষ পরিস্থিতি লা-নিনাকে দায়ী করা যায়। তবে এই অঞ্চলের ভূমির চরিত্র এমন যে, সময় পেলে দ্রুতই পানি নেমে যেতে পারবে।

এদিকে বর্ষণের অবস্থানগত চিত্র দুদিনে পাল্টাচ্ছে। রোববার সকাল থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত মূল বৃষ্টি হয়েছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল তথা পার্বত্য এলাকা, চট্টগ্রাম ও এর আশপাশে। যে কারণে ওই অঞ্চলের প্রধান নদী মুহুরী, ফেনীহালদা, সাঙ্গু আর মাতামুহুরীতে পানি প্রবাহ বেড়েছে। মুহুরী নদীতে একদিনেই ৩০৮ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে ফেনীর পরশুরাম পয়েন্টে। ওই এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্ককরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) বলছে, আগামী ২৪ ঘণ্টা এই অঞ্চলে অতি ভারি বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে। এ কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি ও বান্দরবানের নদ-নদীগুলোতে পানির উচ্চতা দ্রুত বাড়তে পারে। এফএফডব্লিউসি আরও জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হওয়া ১৫টি স্থানের মধ্যে ১০টিই উল্লিখিত অববাহিকায়। সর্বোচ্চ বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে চট্টগ্রামে ২৪২ মিলিমিটার। ফেনীর পরশুরামে ১৭৫, রাঙামাটিতে ১৫৫, টেকনাফে ১৪৬, কুমিল্লায় ১০০, বান্দরবানে ৯৫, কক্সবাজারে ৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ১৫টির মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে বান্দরবানের লামায় ৮১ মিলিমিটার।

সাধারণত কোনো এলাকায় ২৪ ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তা স্থানীয় আর ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তা ১০ দিনব্যাপী বন্যার সৃষ্টি করে। এই হিসাবে আগের পানির সঙ্গে নতুন পানি যুক্ত হয়ে পরিস্থিতি উন্নতি হতে দিচ্ছে না। সিলেটসহ বন্যাকবলিত অঞ্চলে।

এদিকে বৃষ্টির প্রকোপ কমে যাওয়ায় সিলেটসহ পূর্বাঞ্চল থেকে বন্যার পানি কিছুটা নেমেছে সোমবার। সবচেয়ে বেশি ২৮ সেন্টিমিটার নেমেছে সিলেটের কানাইঘাটে সুরমার পানি। কলমাকান্দায় সোমেশ্বরীর পানি ২০ সেন্টিমিটার আর দিরাইতে পুরোনো সুরমার পানি ৬ সেন্টিমিটার নেমেছে। কিন্তু কুশিয়ারাসহ খোয়াই বা সিলেটের অন্যান্য নদীর পানি বেড়েছে। এই অঞ্চলে বিপৎসীমার সবচেয়ে ওপরে আছে কুশিয়ারা অমলশীদ পয়েন্টে। সেখানে এটি বিপৎসীমার ১৮৪ সেন্টিমিটার ওপরে আছে। এফএফডব্লিউসি বলছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতি একই থাকবে। কিন্তু অবনতি ঘটবে হবিগঞ্জে। এদিকে আবহাওয়া বিভাগ (বিএমডি) জানিয়েছে, আগামী দু-একদিনে সিলেট বিভাগে বৃষ্টির প্রবণতা কম থাকলেও এরপর ফের বাড়বে। সবমিলে আগামী অন্তত ৯ দিন সিলেটে বৃষ্টি থাকতে পারে। তবে মেঘ ছড়িয়ে পড়ায় অতিভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা কম। বৃষ্টি সিলেটের পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও বরিশাল অঞ্চলেও থাকবে। সিলেট অঞ্চলে ২৯ জুন পর্যন্ত ৪৮০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। এর ফলে পানি না নামতেই আবার বেড়ে যাবে। তাই এ মাসের বাকি দিনগুলোতেও এই অঞ্চলে বন্যা বিরাজ করতে পারে। আর চট্টগ্রাম ও বরিশাল অঞ্চলে একই সময়ে প্রায় ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। পাশাপাশি ঢাকা, রংপুর ও রাজশাহীতে বৃষ্টি বাড়বে। এদিকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকায়ও সিলেট বিভাগের মতোই বড় বন্যা চলছে।

এফএফডব্লিউসির নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, আগামী ২৪ ঘণ্টায় লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।

তিনি আরও জানান, আবহাওয়া সংস্থাগুলোর গাণিতিক মডেলভিত্তিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, ধরলা ও দুধকুমোরসহ সব প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।

সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, এই মুহূর্তে দেশের ৯টি নদ-নদীর পানি ১৯টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে-ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ধরলা, ঘাঘট, সুরমা, কুশিয়ারা, খোয়াই, পুরোনো সুরমা ও সোমেশ্বরী। বাগেরহাটে পশুরও বিপৎসীমার ওপরে ছিল সোমবার সন্ধ্যায়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিস্তা বিপৎসীমার ওপরে চলে যেতে পারে। মৌলভীবাজারে মনু, ফেনীতে মুহুরী, বাঘাবাড়ীতে আত্রাই-করতোয়া বিপৎসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে।

সূত্র: যুগান্তর

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়