প্রকাশ : ১০ জুন ২০২২, ০৮:১৯
পাহাড়িদের জীবন বদলে দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
চারদিকে উঁচু-নিচু ছোট-বড় পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা বন জঙ্গল। এর মাঝেই পাহাড়ি উপজাতিদের জীবন-জীবিকা। সংগত কারণেই প্রত্যন্ত এই অঞ্চলের বাব-মা স্বপ্নেও ভাবতো না সন্তানরা লেখাপড়া শিখবে। স্কুলে যাবে। বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসেবা কোনো কিছুরই সুযোগ ছিল না। অসুখ-বিসুখে কবিরাজি টোটকাই ছিল ভরসা। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে জুমে উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য ক্ষেতেই পঁচে যেত।
এখন এমন চিত্র দেখা যায় না পাহাড়ে। দুর্গম পাহাড়ে জ্বলছে বিদ্যুতের বাতি, নির্মাণ করা হয়েছে প্রশস্ত পাকা সড়ক। সমতল ভূমির পাশাপাশি মাঝারি উচ্চতার পাহাড়ে বেড়েছে চাষাবাদ। পর্যটনকেন্দ্র, উন্নত সড়ক ব্যবস্থা- সব মিলিয়ে বদলে গেছে পাহাড়িদের জন-জীবন। এর পেছনে পুরো অবদানটুকু বাংলাদেশ সেনাবহিনীর। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিরলস প্রচেষ্টায় পাহাড় আজ নিরাপদ।তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এখনও চলছে উন্নয়নযজ্ঞ।
আইএসপিআরের তথ্য বলছে, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য তিন জেলাতে যোগাযোগের উপযোগী রাস্তা ছিল ২ হাজার ৮০৩ কিলোমিটার, বর্তমানে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের তত্ত্বাবধানে নির্মিত সড়ক যোগাযোগের পরিধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯৪৯ কিলোমিটার। শান্তিচুক্তির পূর্বে তিন জেলায় হাসপাতাল-ক্লিনিক ছিল মাত্র ২৪টি, এখন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি পর্যায়ে ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে ২৭০টি। শান্তিচুক্তির পূর্বে পাহাড়ে ক্ষুদ্র-মাঝারিসহ কল কারখানা ছিল ১৩৫টি, বর্তমানে ২২৩টিতে উন্নিত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ৮০টি দেশি-বিদেশী এনজিও’র মাধ্যমে ১০১টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এসব প্রকল্পে কর্মরত ৬৪ শতাংশ উপজাতি এবং ৩৪ শতাংশ বাঙালি বাসিন্দা। এসব প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের ৬৩ শতাংশ উপজাতি ৩৭ শতাংশ বাঙালি। পার্বত্য বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও গুইমারা রিজিয়নের অধীনে গত একবছরে পার্বত্যাঞ্চলের উপজাতি জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ৬৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও পূণনির্মাণ করা হয়েছে। সুপেয় পানির কষ্ঠ লাঘবে ১৫টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। ৩৯ হাজার ৪৪৮ পরিবারে খাদ্য সঙ্কট নিবারণে দেয়া হয়েছে ত্রাণ সামগ্রী। বিভিন্ন আর্থিক অনুদান দেয়া হয়েছে ১১ হাজার ২২৪জনকে। ২২০টি ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণ ও পূণনির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। যাত্রী ছাউনি ও ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে ২০টি। এর সবই সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে।
সূত্র মতে, যুগের পর যুগ চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকাগুলো ছিলো অরক্ষিত। সন্ত্রাসী আর উগ্রবাদীদের অভয়ারণ্য। গোষ্ঠীগুলোর পরস্পরবিরোধী কার্যকলাপে প্রায়ই ঘটতো প্রাণহানি। রাষ্ট্রীয়ভাবে দমন-নিপীড়ন করার চেষ্টা হতো অগণতান্ত্রিকভাবে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাহাড়ে শান্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের বিধিবিধান ও আইন অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে কয়েক দফা সংলাপের পর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটি ছিল ঐতিহাসিক এবং যুগান্তকারী চুক্তি।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশের বসবাস তিন পার্বত্য জেলায়। পার্বত্যাঞ্চলের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকিকে দূরে রেখে সেনাবাহিনী কর্তৃক গৃহীত ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও উপজাতিদের কল্যাণমূলক কাজগুলিও করছেন সেনাবাহিনী। এজন্য ইউনিফর্ম পরা সেনা সদস্যদের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশ জনপ্রিয় করে তোলে। শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য জেলায় শান্তি আনার পাশাপাশি ভৌত অবকাঠামো এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। পাহাড়ে অনেক স্থান ছিলো, যেখানে যাওয়া দুষ্কর, সেখানেও এখন সড়কপথ সৃষ্টি হয়েছে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় গড়ে উঠছে বিস্তৃত যোগাযোগ ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আয়বর্ধন মূলক কাজেও রয়েছে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ।
শান্তি চুক্তির পর শিক্ষার মানোন্নয়নে রাঙামাটিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার। শান্তিচুক্তির আগে তিন পার্বত্য জেলায় হাইস্কুল ও কলেজের সংখ্যা ১১টি থেকে বর্তমানে প্রায় ৫শয়ে উন্নীত হয়েছে। প্রতিটি পাড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। শিক্ষার হার দুই থেকে বেড়ে বর্তমানে প্রায় ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে।
একজন আঞ্চলিক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাহাড়ে অত্যন্ত জনপ্রিয়। কারণ তারা পাহাড়িদের সব কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। সেনাবাহিনী এমন সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে যা সরাসরি তাদের জীবনধারা পরিবর্তন করেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে জল সরবরাহ নিশ্চিত করা, যা তাদের কৃষিতে সহায়তা করেছে এবং সড়ক যোগাযোগের উন্নয়নের ফলে তাদের কৃষি পণ্য বাজারজাত করতে সহায়তা করেছে।
সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর পার্বত্য এলাকায় রাস্তা, সেতু এবং অন্যান্য সুবিধা নির্মাণে ব্যাপকভাবে ভূমিকা রাখছে। এসব উন্নয়ন কাজের সময় সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যের মৃত্যুও ঘটেছে। তবুও তারা দেশের স্বার্থে সেরাটা দিয়ে যাচ্ছে।