রবিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৮ °সে

প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১৯:০৪

মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন, ফিরে দেখা ইতিহাসের বাঁক

মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন, ফিরে দেখা ইতিহাসের বাঁক
অনলাইন ডেস্ক

মঙ্গল শোভাযাত্রা— বাংলা নববর্ষের শোভাযাত্রার এ নাম নিয়ে এবার বেশ সরব ছিল ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন। শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন হওয়ার ইঙ্গিতও ছিল।

শুক্রবার সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই সিদ্ধান্তই জানানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে এক সংবাদ সম্মেলনে।

সংবাদ সম্মেলনে চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আজহারুল ইসলাম শেখ জানান, এবার শোভাযাত্রার নাম হচ্ছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।

মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলছেন, আমরা নাম পরিবর্তন করছি না। আমরা পুরোনো নাম এবং ঐতিহ্যে ফেরত যাচ্ছি, যেটা দিয়ে চারুকলার এই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।

মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাচ্ছে— ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ (তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউট) পয়লা বৈশাখে শোভাযাত্রা করে আসছে। শুরুতে এর নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। সেটিরও শুরু মূলত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মোৎসব শোভাযাত্রার মাধ্যমে।

তবে তারও আগে ১৯৮৫ সালে যশোরে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যযন্ত্রসহ বিভিন্ন শিল্পকর্ম ছিল। আর যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে বর্ষবরণের আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হয়।

মঙ্গল শোভাযাত্রা মূলত অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শান্তি ও কল্যাণের প্রতীক। এটি বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং ইউনেস্কো কর্তৃক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃত। শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশখচিত প্ল্যাকার্ড। মিছিলটি নাচে গানে উৎফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করে।

১৯৮৯ সালের শোভাযাত্রা প্রসঙ্গে ৭ এপ্রিল ২০২৪ ঢাকা পোস্টে প্রকাশিত প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজক সদস্য আমিনুল হাসান লিটুর ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’ শিরোনামে মতামত কলামে লেখা হয়েছে— বাংলাদেশ তখন দীর্ঘ স্বৈরশাসনের কবলে আক্রান্ত, দুর্বিষহ-শ্বাসরুদ্ধকর, বন্ধ্যা সময়; তরুণ ছাত্র সমাজ অনাচারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ। তখন চারুকলার সেই শিক্ষার্থীরা স্বৈরশাসককে ইঙ্গিত করে ‘বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক’ প্রতিপাদ্যে পয়লা বৈশাখ ১৩৯৬ বঙ্গাব্দের (১৯৮৯ সাল) সকাল ৮টায় এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করে চারুকলা প্রাঙ্গণ থেকে।

২০২১ ও ২০২২ সালে যথাক্রমে দৈনিক ইত্তেফাক ও সংবাদ সংস্থা ইউএনবিতে প্রকাশিত দুটি লেখাতে পাওয়া যায় সঙ্গীতশিল্পী ওয়াহিদুল হক এবং ভাষা সৈনিক এমদাদ হোসেনের প্রস্তাবে আনন্দ শোভাযাত্রা নাম পরিবর্তন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা রাখা হয়। ইউএনবির তথ্য অনুযায়ী ১৯৯০ সালে নাম পরিবর্তন করা হয়।

নাম পরিবর্তনের সঙ্গে এর পরিসরও বড় হয়। আগের শোভাযাত্রাগুলো যেখানে শুধু ছাত্র-ছাত্রী এবং জুনিয়র শিক্ষকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেখানে মঙ্গল শোভাযাত্রায় সকল শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবীরাও অংশগ্রহণ করেন।

আনন্দ শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা রাখার পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল বলে জানা যায়।

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অমঙ্গল দূর করে মঙ্গলের আহ্বান জানানোর উদ্দেশ্যেই মূলত শোভাযাত্রার নামকরণ করা হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শান্তি ও কল্যাণের বার্তা দেওয়া হয়েছিল।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে, ‘মঙ্গল’ শব্দটি নিয়ে কিছু বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, এই পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য হলো শোভাযাত্রাকে আরও সর্বজনীন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক করা, যেখানে দেশের বিভিন্ন জাতিসত্তা ও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।

বিষয়টি নিয়ে গত রোববার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছিলেন, কোনো কোনো সংস্কৃতিকে বা তার জনগোষ্ঠীকে, তার আচারকে, রীতিনীতিকে এক্সক্লুড করাটা কোনো সমাজের জন্য মঙ্গলজনক না। এটা আমরা দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছি, এটা ভালো। এই যে সকল সংস্কৃতির সব ধারাকে এক জায়গায় আনা, এটা ৩০ বছর আগে হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমরা এখন করবার চেষ্টা করছি। এবারের শোভাযাত্রা যেটা চারুকলা থেকে বের হবে, সেখানে আপনারা সত্যিকার অর্থেই নতুন জিনিস দেখবেন। আপনাদের চোখেই পরিবর্তন দেখতে পারবেন অনেক। আসলেই নতুন কিছু দেখবেন, নতুন রঙ দেখবেন, নতুন গন্ধ পাবেন, নতুন সুর পাবেন।

মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে এ শোভাযাত্রা শুরু হয়নি উল্লেখ করে ফারুকী বলেছিলেন, এটার নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা, সেখান থেকে হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। যে নাম একবার পরিবর্তিত হয়েছে, যদি সবাই সর্বসম্মত হয় তাহলে পরিবর্তিত হবে, সবাই সর্বসম্মত না হলে নাও হতে পারে।

আপত্তি ছিল আগেও মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে বির্তক মূলত আগে থেকেই ছিল। এই আয়োজন নিয়ে বিভিন্ন সময় আপত্তির কথা জানিয়েছে বিভিন্ন ইসলামপন্থি সংগঠন। তাদের দৃষ্টিতে, এই শোভাযাত্রাটি হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে এসেছে। বিগত সময়ে পয়লা বৈশাখ পালনের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি নির্দেশনা দেওয়ার পর এর বিরোধিতাও করতে দেখা গেছে অনেক সংগঠনকে।

তবে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজকরা বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে কোনো ধর্মীয় বিষয়ের সম্পর্ক নেই এবং যেকোনো ধর্মের উৎসবের বাইরে বাঙালি হিসেবে সার্বজনীন একটি উৎসব হিসেবেই সূচনা হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রার।

কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম এ বছরও তাদের একটি বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় প্রতিবছরই তাদের দেবতা শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীতে সাড়ম্বরে মঙ্গল শোভাযাত্রা পালন করে থাকে। সংখ্যালঘুর যে কোনো ধর্মীয় উৎসব পালনের স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রতি আমরা প্রতিশ্রুতিশীল। কিন্তু পয়লা বৈশাখ উদযাপনে হিন্দু সম্প্রদায়ের এই ধর্মাচারকে তথাকথিত ‘সর্বজনীনতা’র নামে সবার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে ফ্যাসিবাদী সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। মূলত আমাদের জাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্য থেকে মুসলিম সংস্কৃতি ও ভাবধারাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে এই সেক্যুলার সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ কায়েম করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ সেক্যুলার ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়