প্রকাশ : ১২ মে ২০২৪, ০৮:৪৯
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি সংরক্ষণ প্রকল্পে খরচ কমছে ৪৯ কোটি টাকা
নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে- এমন ঘটনা আমাদের দেশে বিরল। প্রকল্প মানেই সময়-ব্যয় বৃদ্ধির খেলা। যে কোনো প্রকল্পে সময় বাড়ার সঙ্গে বাড়ে ব্যয়। তবে ব্যতিক্রম একটি প্রকল্প। আলোচিত এ প্রকল্পের কাজের পরিধি বেড়েছে, সময়ও বেড়েছে; অথচ খরচ কমেছে ৪৯ কোটি ২০ লাখ টাকা।
এমন ঘটনা ঘটেছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্পে। এ প্রকল্পের আওতায় সংরক্ষণ করা হবে ২০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সমাধিস্থল। যদিও প্রকল্প বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি নেই। যথাসময়ে নিয়োগ করা হয়নি প্রকল্প পরিচালক। শহীদ ও মৃত অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যথাসময়ে না পাওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হলেও বেশকিছু খাতে বরাদ্দ বাদ দেওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় কমছে।
চলমান প্রকল্পের আওতায় খাতভিত্তিক ব্যয় বিভাজনের ক্ষেত্রে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, টিফিন ভাতা, যাতায়াত ভাতা, পেট্রোল-লুব্রিকেন্ট, গ্যাস-জ্বালানি, অনুলিপি ব্যয়, সেমিনার-কনফারেন্স সহ কিছু সাধারণ ব্যয় বাদ দিতে বলেছে পরিকল্পনা কমিশন। এসব খাতে ব্যয় বাদ দেওয়ায় খরচ কমেছে এ প্রকল্পের।
সম্প্রতি এ বিষয়ে সভা করে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি)। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) রেহানা পারভীন। সভায় প্রকল্পের বিষয়ে বেশকিছু সিদ্ধান্ত হয়। এতে প্রকল্পের বেশ কয়েকটি খাতে ব্যয় কমানোর কথা বলা হয়েছে। প্রকল্পের অঙ্গভিত্তিক ব্যয় বিভাজনের ক্ষেত্রে আলোচনা করে অফিস ভবন, সম্মানী ব্যয়, অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ব্যয়, কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক, আসবাবপত্র, স্ট্যাম্প ও সিল ইত্যাদি বাদ দিয়ে ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে।
এছাড়া প্রকল্পের অফিস ভবনের ভাড়া বাবদ ব্যয় ৪০ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ১৮ লাখ টাকা, অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি বাবদ ব্যয় ৬ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ২ লাখ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে। ফলে খরচ আরও কমবে বলে মনে করছে কমিশন।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন যে সিদ্ধান্ত নেবে সে অনুযায়ী প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) পুনর্গঠন করা হবে বলে জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) কামরুন নাহার বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ চলমান। প্রকল্পের আওতায় কিছু ব্যয় কমবে। এছাড়া মেয়াদ বাড়ানোসহ কিছু বিষয় নিয়ে পিইসি সভা হয়েছে। এখন সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন।’
প্রকল্পের অফিস ভবনের ভাড়া বাবদ ব্যয় ৪০ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ১৮ লাখ টাকা, অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি বাবদ ব্যয় ৬ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ২ লাখ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে। ফলে খরচ আরও কমবে বলে মনে করছে কমিশন।
প্রকল্প থেকে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ও টিফিনভাতা বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘এটা কমিশনের সিদ্ধান্ত। তারা যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই হবে।’
জানা যায়, ২০ হাজার সমাধিস্থল নির্মাণের জন্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়নে এ প্রকল্প নেওয়া হয়। যার বাস্তবায়নকাজ চলছে। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৬০ কোটি ৯৭ লাখ ৮৯ হাজার টাকা, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের আওতায় দেশব্যাপী ২০ হাজার শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি নির্মাণের কথা রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্পের মেয়াদ ৩ বছর বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। বর্তমানে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় কমানো হয়েছে ৪৯ কোটি ২০ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ আরও দেড় বছর বাড়ানোর প্রস্তাবসহ ৩৯৬ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য সংশোধিত ডিপিপি পাঠিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
প্রকল্পটি দেশের ৬৪ জেলার সব উপজেলা ও মহানগরে বাস্তবায়িত হবে। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি ৭৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, কাজের অগ্রগতি ২০ শতাংশ।
মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের হাতে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল এবং বিভিন্ন সময়ে মৃত্যুবরণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়নে নেওয়া হয় এ প্রকল্প। প্রাথমিকভাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণের জন্য এক হাজার ৩৩৮টি সমাধিস্থল তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে প্রকল্পের কার্যপরিধি সম্প্রসারণ করে শুধুমাত্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য না করে মৃত্যুবরণকারী সব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সমাধি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। পর্যায়ক্রমে মোট ২০ হাজার সমাধিস্থল সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে নির্ধারিত ৪০ হাজার সমাধির মধ্যে প্রথম পর্যায়ে সংরক্ষণ করা হবে ২০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সমাধিস্থল।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, মূল প্রকল্পের আওতায় নির্মাণকাজের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তরের ২০১৮ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী। প্রকল্পের আওতায় মোট ২০ হাজার সমাধিস্থলে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এরই মধ্যে ৪ হাজার ৫০০ সমাধিস্থলের তালিকা মিলেছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৭০০ সমাধিস্থলে স্মৃতিসৌধ নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি মাত্র ২০ শতাংশ। বাকি ১৫ হাজার ৫০০ সমাধিস্থলের তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে। যেমন- সমাধিস্থলের অবস্থান, জমির প্রাপ্যতা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হবে।
প্রাথমিকভাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণের জন্য এক হাজার ৩৩৮টি সমাধিস্থল তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে প্রকল্পের কার্যপরিধি সম্প্রসারণ করে শুধুমাত্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য না করে মৃত্যুবরণকারী সব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সমাধি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সমাধিস্থলের নকশা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিসৌধের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নকশা। সভায় হিন্দু সম্প্রদায়ের স্মৃতিসৌধের নকশায় গম্বুজ স্মৃতিসৌধের একপাশে না রেখে মাঝখানে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। উত্তরাধিকারীদের সম্মতিক্রমে পৃথক নকশায় সমাধি করা যাবে বলে উল্লেখ রয়েছে ডিপিপিতে। তবে এতে ব্যয় প্রাক্কলন বিষয়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
এছাড়া এসব সমাধি যেহেতু সরকারি অর্থায়নে হবে, সেহেতু সরকার নির্ধারিত একই নকশা অনুযায়ী সব সমাধিস্থল নির্মাণের পরামর্শ এসেছে। প্রকল্পের আওতায় যেসব স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হবে, সেসব নির্মাণাধীন স্মৃতিসৌধ রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ে সভায় আলোচনা হয়। এসব স্মৃতিসৌধ নির্মাণ পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ক রূপরেখা তৈরি করে তা পুনর্গঠিত ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পরামর্শ দেওয়া হয় সভায়।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের (স্কাইসোয়াম উইং) যুগ্ম-প্রধান আহমদ কবীর বলেন, ‘প্রকল্পটি নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে পিইসি সভা হয়েছে। সভা থেকে প্রকল্পের বিষয়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ ও সংশোধনী দেওয়া হয়েছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য অপেক্ষা করছি, তারা কী সংশোধনী দেয়। তাদের সংশোধনীর পরেই আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো। একই ধরনের সংশোধনী পেলে পরবর্তী ধাপে একনেক সভায় উপস্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করবো। আর যদি পিইসি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংশোধনী না আসে, তবে আবারও সভা হতে পারে।’