প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:২০
তফসিল ভাষণে যা বললেন সিইসি
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের ওপর জোর দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘পারস্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়।’ তিনি নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, নির্বাচনে সব দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে নির্বাচন কমিশন স্বাগত জানাবে।
বুধবার (১৫ নভেম্বর) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় তিনি এসব কথা বলেন। সিইসি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে সরাসরি ভাষণের মাধ্যমে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করেন।
সংবিধানে জনগণকে ক্ষমতার মালিক ঘোষণা করা হয়েছে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় জনগনের সেই মালিকানা প্রতিষ্ঠার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে অবাধ ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন।’
আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যে সরকার সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি বারংবার ব্যক্ত করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনও তার আয়ত্তে থাকা সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে এবং সরকার থেকে আবশ্যক সব সহায়তা গ্রহণ করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করার বিষয়ে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করবে।’
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বকালীন কার্যক্রম তুলে ধরে সিইসি বলেন, ‘আমরা দায়িত্বগ্রহণের পর ১৬টি উপনির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের সহস্রাধিক নির্বাচন করেছি। আগ্রহী সব রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী সমাজ, শিক্ষাবিদ, নাগরিক সমাজ ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে একাধিকবার সংলাপ ও মতবিনিয় করেছি। নিবন্ধিত অনাগ্রহী সব রাজনৈতিক দলকেও একাধিকবার আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তারা আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদপূর্তির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সংবলিত এই নির্দেশনা নির্বাচন কমিশন সরকারের নির্বাহী বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিয়ে সম্পন্ন করে থাকে।’
সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত সহযোগিতা ও অংশগ্রহণে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হতে পারে মন্তব্য করে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে কার্যকরভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে কেন্দ্রে কেন্দ্র ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। নির্বাচন অধিক পরিশুদ্ধ ও অর্থবহ হয়। জনমতের শুদ্ধতর প্রতিফলন ঘটে। নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্রমান্বয়ে সংহত ও টেকসই হয়। গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন হয়।’
বাংলাদেশের জনগণ রাজনীতির বিষয়ে সচেতন উল্লেখ করে নির্বাচনের বিষয়েও জনগণ সমভাবে সচেতন হয়ে এর গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন বলে সিইসি আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘প্রার্থীরা এ বিষয়ে প্রচারণার মাধ্যমে ভূমিকা পালন করে থাকবেন। কমিশনও সর্বসাধারণ বিশেষত ভোটারকে সচেতন করতে প্রচারণামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।’
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলকে আচরণবিধি প্রতিপালন করতে হবে বলে হুঁশিয়ার উচ্চারণ করেন তিনি। সিইসি বলেন, ‘নির্বাচনি দায়িত্বে নিয়োজিত সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে আইন ও বিধিবিধান যথাযথভাবে অনুধাবন, প্রতিপালন ও প্রয়োগ করে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে আরোপিত দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
সিইসি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভোটকেন্দ্রগুলোর পারিপার্শ্বিক শৃঙ্খলাসহ প্রার্থী, নির্বাচনি কর্মকর্তাসহ সর্বসাধারণের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। জালভোট, ভোট কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই, অর্থের লেনদেন ও পেশিশক্তির সম্ভাব্য ব্যবহার নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যেকোনও মূল্যে সম্মিলিতভাবে তা প্রতিহত করতে হবে।’
অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণূলক ও উৎসবমূলক নির্বাচনের জন্য কাঙ্ক্ষিত অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন প্রশ্নে বিশেষত নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির প্রশ্নে দীর্ঘ সময় ধরে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বহুদলীয় রাজনীতিতে মতাদর্শগত বিভাজন থাকতেই পারে। কিন্তু মতভেদ থেকে সংঘাত ও সহিংসতা হলে তা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। মতৈক্য ও সমাধান প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলকে বিনীতভাবে অনুরোধ করবো—সংঘাত ও সহিংসতা পরিহার করে সদয় হয়ে সমাধান অন্বেষণ করতে। জনগণকে অনুরোধ করবো—সব উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তি পরাভূত করে নির্ভয়ে আনন্দমূলক পরিবেশে ভোটকেন্দ্রে এসে অবাধে মূল্যবান ভোটাধিকার প্রয়োগে করতে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে সব দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সর্বদা স্বাগত জানাবে। পারস্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়।’
সিইসি তার ভাষণে দ্বাদশ নির্বাচনের প্রস্তুতির কথাও তুলে ধরেন। এ সময় ভোটার তালিকা, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করার কথা জানান।
জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন একটি বিশাল, কঠিন ও জটিল কর্মযজ্ঞ জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘আইন ও বিধিবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, সহজ, দক্ষ ও সুশৃঙ্খল করতে অনলাইন পদ্ধতিতে নমিনেশন দাখিল এবং ডিজিটাল অ্যাপ কমিশন সম্প্রতি চালু করেছে।’
নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশে উৎসাহ-উদ্দীপনা, সাহস ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভোটকেন্দ্রে এসে নির্বিঘ্নে স্বাধীনভাবে আপনাদের মূল্যবান ভোটাধিকার প্রয়োগ করে, পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করে সংসদ ও সরকার গঠনে নাগরিক দায়িত্ব পালন করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন সিইসি। ভোটারদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘ভোট আপনার। ভোট প্রদানে কারও হস্তক্ষেপ বা প্ররোচনায় প্রভাবিত হবেন না। কোনও হস্তক্ষেপ বা বাধার সম্মুখীন হলে একক বা সামষ্টিকভাবে তা প্রতিহত করবেন। প্রয়োজনে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারকে অবহিত করবেন। প্রিজাইডিং অফিসার যেকোনও মূল্যে যেকোনও অপচেষ্টা প্রতিহত করে ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আইনত দায়িত্বপ্রাপ্ত ও বাধ্য বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
নির্বাচনে গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের সহায়তা প্রত্যাশা করে সিইসি বলেন, ‘স্বচ্ছতা বা দৃশ্যমানতা নির্বাচনের বিশুদ্ধতা ও নিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। আমরা দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের সহযোগিতা একান্তভাবে কামনা করছি। ডিজিটাল প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করে দায়িত্বশীল ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়াকে যতদূর সম্ভব দৃশ্যমান করে উপস্থাপন করা গেলে সৃষ্ট স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের বিশুদ্ধতা ও নিরপেক্ষতা প্রতিপাদিত হতে পারে। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় কমিশনের আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতা থাকবে। পক্ষান্তরে অসত্য, মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য সম্প্রচার করে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া ও নির্বাচনকে প্রভাবিত করার যেকোনও অপপ্রয়াস প্রতিহত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে।’
প্রার্থীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কেন্দ্রে সাহসী, সৎ, দক্ষ ও অনুগত পোলিং এজেন্ট নিয়োগ করে প্রার্থী হিসেবে নিজ নিজ অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষার প্রাণান্ত চেষ্টা কার্যত আপনাদেরই করতে হবে।’
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘সব কর্মকর্তা সৎ, নিরপেক্ষ ও অবিচল থেকে আইন ও বিধিবিধান অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবেন। সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বশীল আচরণ ও আবশ্যক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ হবে। দেশে ও বহির্বিশ্বে প্রশংসিত ও বিশ্বাসযোগ্য হবে। দেশের জনশাসনে জনগণের জনপ্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্র সুসংহত হবে।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সফল ও ফলপ্রসূ হবে, এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করে সিইসি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক দল ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীসহ জনগণের আন্তরিক অংশগ্রহণ ও সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করেন।