প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২৩, ০১:৩৯
বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই যে নির্দেশগুলো জারি করা হয়
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার পরপর তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাতারাতি রাষ্ট্রপতি হয়ে যান। ক্ষমতাসীন হয়েই ঘাতকদের প্রেসক্রিপশন মোতাবেক একের পর এক নির্দেশনা জারি করতে থাকেন। এর সবই ছিল নীলনকশার অংশ। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের সংবিধান তথা রাষ্ট্রের চরিত্রকে পাল্টে ফেলে আবারও পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল বলেই সেদিকেই তারা শুরুর দিন থেকে হাঁটতে থাকে।
মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের আগের দফতরই বহাল
বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার একটি বড় অংশ খন্দকার মোশতাকের নতুন মন্ত্রিসভায় শপথ নিয়েছিল। মাত্র যে কয়েকজন এই ষড়যন্ত্রের অংশ হতে রাজি হননি, পরবর্তী সময়ে তাদের নানাবিধ হেনস্তা ও হত্যার মতো পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছিল। ১৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এই মর্মে এক আদেশ জারি করেন যে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা ১৪ আগস্ট পর্যন্ত যিনি যে দফতরের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন, তিনি সেসব দফতরের দায়িত্ব পালন করবেন। দুজন নবনিযুক্ত প্রতিমন্ত্রীর দফতর শিগগির ঘোষণা করা হবে।
সব মুক্তিপ্রাপ্ত সংবাদচিত্র প্রত্যাহার
১৪ আগস্ট অথবা তার আগে ফিল্ম ও গণযোগাযোগ বিভাগ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রামাণ্যচিত্র ও সংবাদপত্র প্রত্যাহার করে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়। যেসব প্রেক্ষাগৃহে এসব সংবাদচিত্র প্রদর্শন করা হচ্ছিল, তা মন্ত্রণালয়ের কাছে অবিলম্বে জমা দিতে বলা হয়। দৈনিক বাংলায় ১৭ আগস্ট একজন সরকারি মুখপাত্রের বরাত দিয়ে এ কথা প্রকাশ করে।
বিআইডব্লিউটিসি কর্মচারীদের প্রতি নির্দেশ
খাদ্যশস্য ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ সচল রাখার জন্য বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ জলপরিবহন সংস্থার সব অফিসার ও কর্মচারীদের অবিলম্বে কাজে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। এই নির্দেশে বলা হয়, বিআইডব্লিউটিসির ভাসমান উপকূলীয় অফিস এবং ডকইয়ার্ডের সব অফিসার ও কর্মচারীকে সংশ্লিষ্ট এলাকার অফিসে ও সদর দফতরে রিপোর্ট করতে হবে।
কারফিউ পাস দেওয়ার ব্যবস্থা
যেসব অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস সংস্থাকে ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হয়, সেগুলোতে কর্মরত ব্যক্তিদের কারফিউ পাস দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে, বঙ্গবন্ধু হত্যার দ্বিতীয় দিনে ঢাকার এক সরকারি ঘোষণায় এ কথা বলা হয়। প্রতিটি পত্রিকায় বাসস পরিবেশিত এই খবর প্রকাশ হয়। নির্দেশনামার আওতায় যেসব সার্ভিস পড়ে, সেগুলো হচ্ছে–হাসপাতাল, পানি সরবরাহ, সরকারি যানবাহন, বিদ্যুৎ সরবরাহ, টেলিগ্রাম ও টেলিফোন, ফায়ার ব্রিগেড, গ্যাস, পেট্রোল, ডিজেল এবং পৌরসভার প্রধান প্রধান সার্ভিস।
১৯৭৫-এর ১৬ আগস্ট নব্য রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমেদের সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ৪০ মিনিট স্থায়ী এই বৈঠকে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের সর্বশেষ মূল্যায়ন অনুযায়ী দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে সন্তোষজনক বলে বর্ণনা করা হয়।
মোশতাক আহমেদ তার ৮৩ দিনের কর্মকাণ্ডে জাতীয় পোশাক কেমন হবে থেকে শুরু করে সংবিধান কাটাছেঁড়া করেন। কী উদ্দেশ্য ছিল? ২০২২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে (৪ নভেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম কিছু প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর কারণ হিসেবে নানা অজুহাতের কথা বলা হয়। তবে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথ থেকে সরিয়ে নেওয়াই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অন্যতম কারণ ছিল। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘সামগ্রিক প্রেক্ষাপট ও অবস্থা বিবেচনায় অত্যন্ত ন্যায্য ও স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে, রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতার অজুহাতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়ে থাকলে তড়িঘড়ি করে সংবিধান কাটাছেঁড়ার প্রয়োজন হয়ে পড়লো কেন?’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যদি আরও একটু নিখুঁতভাবে পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করি, তাহলে সহজেই বুঝতে পারবো, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মাত্র গুটি কয়েক বাক্য ও শব্দ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ঘাতক চক্র ও তাদের কুশীলবরা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সুপরিকল্পিতভাবেই আমাদের সংবিধান তথা রাষ্ট্রের চরিত্রকে পাল্টে ফেলে আবারও পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল।
শুরুতেই একের পর এক নির্দেশনা জারির মাধ্যমে সবার মধ্যে আস্থা আনার চেষ্টা ছিল উল্লেখ করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বলেন, খুনি মোশতাকের তখন অনেক কাজ করার মধ্য দিয়ে নিজের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণেরও দরকার ছিল। ফলে প্রথম এক মাসের মধ্যেই প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় নানা নির্দেশ দিতে দেখা গেছে।