প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২৩, ১৫:১৬
সাংবাদিক নাদিম হত্যা : প্রধান আসামি বাবুর সব কুকীর্তি
-
একসময় করতেন যুবদল
-
চাচাতো ভাই অতিরিক্ত আইজিপি হওয়ার পর থেকে ক্ষমতার দাপট বেড়ে যায়
জামালপুরের বকশিগঞ্জে সাংবাদিক নাদিম হত্যার পর প্রধান আসামী সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল আলম বাবুর বিরুদ্ধে আসছে নানা অভিযোগ। এতোদিন সবাই চুপ থাকলেও একে একে মুখ খুলছেন বাবু চেয়ারম্যানের হাতে নির্যাতিতরা। এছাড়া ভোরের কাগজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়নের কামালের বার্ত্তী গ্রামের মৃত শাহাজল মাস্টারের ছেলে মাহমুদুল আলম বাবু। ছয় ভাইবোনের মধ্যে বাবু চতুর্থ। স্কুল শিক্ষক বাবার ছেলে বাবুর জীবনে ছিল না কোনো চাকচিক্য। কামালের বার্ত্তী বাজারে একটি ছোট্ট মুদি দোকান পরিচালনা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন বাবু। বিবাহিত জীবনে দুই ছেলে সন্তানের জনক বাবু।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির ক্ষমতার শেষের দিকে মুদি দোকানের ব্যবসা ছেড়ে দেন বাবু। তার নিকটাত্মীয় জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা বিএনপির একজন নেতা ঠিকাদারি কাজ করতেন গ্রামীণ ফোনের টাওয়ারে। আত্মীয়তার খাতিরে বাবুকে সেই টাওয়ারে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ দেন সেই বিএনপি নেতা।
সেসময় যুবদল করতেন বাবু। তবে ছাত্রজীবনে জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে বাবুর জড়িত থাকার কথা শোনা যায়। ধীরে ধীরে সখ্যতা বাড়তে থাকে তার আত্মীয়ের সঙ্গে। পরে সেই গ্রামীণ ফোনের টাওয়ারের কাজ শেষে নিজেই ঠিকাদারি শুরু করেন বাবু। বেশ অর্থকড়ি হাতে আসার পর ২০১০ সালে সাবিনা ইয়াসমিন নামে এক নারীকে প্রলোভন দেখিয়ে বিয়ে করেন বাবু।
বকশিগঞ্জ শহরের বাগানবাড়ি এলাকায় সেই সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে কথা হয় ভোরের কাগজের। সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ২০১০ সালে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাকে বিয়ে করেন বাবু। এরপর থেকে তাকে শুধু জৈবিক চাহিদার জন্য ব্যবহার করেন বাবু। কোনো দিন স্ত্রীর মর্যাদা দেননি। ২০২২ সালের শেষের দিকে তাদের ঘরে একটি সন্তান জন্ম নেয়ার পর স্ত্রীর মর্যাদা চাই আমি। তখনই আমার সঙ্গে তার বিরোধ শুরু হয়। তিনি আমাকে বিপদে ফেলার জন্য নানা পাঁয়তারা করেন।
তিনি অভিযোগ করেন, বাবুর চাচাতো ভাই মোখলেছুর রহমান পান্না পুলিশের ডিআইজি হওয়ার পর থেকে বদলে যেতে শুরু করে তাদের জীবনযাত্রা। ২০১১ সালে সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন মাহমুদুল আলম বাবু। সেই নির্বাচনে পরাজিত হন তিনি। এরপর ২০১২ সালে নাম লেখান আওয়ামী লীগে।
চাচাতো ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে জয়ী হন বাবু। তখন থেকে বাবু হয়ে যান বাবু চেয়ারম্যান। এরপর সবশেষ ২০২১ সালেও চেয়ারম্যন নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে জয়ী হন বাবু। এর মধ্যে আবার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ পান বাবু।
বাবু চেয়ারম্যানের সম্পদের হিসাব জানতে চাইলে সাবিনা ইয়াসমিন তার সম্পদের একাংশের বর্ণনায় জানান, গাজীপুর জেলার সাইনবোর্ড এলাকায় বাবুর বিশাল এক জমিতে ১৪টি ঘর রয়েছে। বকশিগঞ্জ পৌরসভার ব্র্যাক অফিসের দিকে ৫ শতাংশ জমির উপর একটি বাড়ি, একই এলাকার রাইস মিলের পাশে ৭ বা ১০ শতাংশ জমি রয়েছে। বাগানবাড়ী এলাকায় ১০ শতাংশ জমির একটি প্লট আছে। তার গ্রামের বাড়ি কামালের বার্ত্তী বাজারের চার ভাগের তিন ভাগ জায়গা বাবু চেয়ারম্যানের। সেখানে একটি তিন তলা বিল্ডিংয়ে মার্কেট ও তার ব্যক্তিগত অফিস রয়েছে। বাজারের পেছনে দুতলা একটি ভবনের কাজ নির্মাণাধীন।
এছাড়াও একই বাজারে আরো দুটি মার্কেট রয়েছে বাবু চেয়ারম্যানের। ৭০-৮০ বিঘার মতো কৃষি জমি রয়েছে তার। তার কাছে নগদ টাকা ও ব্যাংকে টাকা-পয়সার হিসাব নাই। পৈতৃক সূত্রে কামালের বার্ত্তী বাজার এলাকায় তার দুইটি বাড়ি। একটি পুরাতন বাড়ি আর একটি নতুন বাড়ি। তার সব বাসায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার আসবাবপত্র রয়েছে। তার প্রথম স্ত্রীর অলংকারের কোনো হিসাব নেই।
সবশেষে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, তার চাচাতো ভাই মোখলেছুর রহমান পান্না যখন অতিরিক্ত আইজিপি হয় তখন বাবুর ক্ষমতার দাপট আরো বেড়ে যায়। তার কথার বাইরে গেলে আমাকে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করত। স্ত্রীর মর্যাদা চাইতে গেলে বাবু আমাকে হয়রানি করে। তখন মোখলেছুর রহমান পান্নাকে ফোন দিলে তিনি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ফোন কেটে দেন। এসব বিষয় নিয়ে সংবাদ করাই সাংবাদিক নাদিমের কাল হয়ে দাঁড়াল।
সাংবাদিক নাদিম হত্যার প্রধান আসামি বাবুর বিষয়ে অনুসন্ধানে গিয়ে কথা হয় কামালের বার্ত্তী এলাকার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের ছেলে মোঃ নাহিদ হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাবু চেয়ারম্যান টাকার জন্য সব কাজই করেন। অবৈধ ডলার ব্যবসা, মাদক ব্যবসায়ীদের থেকে চাঁদাবাজি, সালিশ বাণিজ্য, জমি দখল, নিয়োগ বাণিজ্য, সুপারিশ বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য করে তিনি মুদি দোকান থেকে আজ কোটি কোটি টাকার মালিক।
নাহিদ হাসান অভিযোগ করেন, বাজারে তাদের একটি দোকান ছিল। সেই দোকান দখল করে নিয়েছে বাবু চেয়ারম্যান। প্রশাসনের কাছে বিচার দিলে বাবু তাকে হত্যার হুমকি দেন। তিনি এখনো ভয়ে বাজারে যান না। বাবু চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাই পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেছুর রহমান পান্না। তার নাম ব্যবহার করে ক্ষমতার দাপট দেখাতেন তিনি।
একই এলাকার আবু সাইদের ছেলে মো: কিসমত আলী বলেন, সাধুরপাড়া ইউনিয়নে যদি কোনো একটি ঘটনা ঘটত। সেই ঘটনাই দুই পক্ষের কাছ থেকেই টাকা নিত বাবু চেয়ারম্যান। তার কাছে কালো টাকার পাহাড়। তার তিন তলা মার্কেটের ব্যাক্তিগত অফিস হলো টর্চার সেল। তার কথা কেউ না শুনলে সেখানে নিয়ে গিয়ে শারীরিকভাবে নির্যাতন করত বাবু। আর সেখানেই সব বিচার সালিশ হতো।
সাধুরপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আবুল হোসেন বলেন, আমি কয়েক বছর আগে আমার পরিবারের একটা বিচারের জন্য বাবু চেয়ারম্যানকে ২০ হাজার টাকা দিই। বাবু চেয়ারম্যান আমার প্রতিপক্ষের কাছ থেকে আরো বেশি টাকা নেয়। সেই বিচারে বাবু চেয়ারম্যান আর যায় নাই। আমার বিচারটা করে নাই।
শুধু সাধারণ জনগণ নয়। বাবু চেয়ারম্যানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ তার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরাও। সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৮নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোফাজ্জ্বল হক বলেন, আমাদের পরিষদের নিয়ম অমান্য করে তিনি তার নিজের লোকদের প্যানেল চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। ২নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. আকরাম হোসেন বলেন, আমি পরিষদে যাই না।
কারণ বাবু চেয়ারম্যানের অনৈতিক কথা আমি মানি না। কারো কাছ থেকে অবৈধভাবে টাকা কামাই করে দেই না। তাই তিনি আমার ওয়ার্ডে কোনো বরাদ্দ দেন না। আমিও পরিষদে যাই না। এছাড়াও তিনি সরকারি বরাদ্দের অধিকাংশ চাল বিক্রি করে দেন। সরকারি বরাদ্দ বিতরণে তার অনেক অনিয়ম রয়েছে।
৪,৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য আমেনা বেগম বলেন, বাবু চেয়ারম্যান আমাদের একজন মহিলা মেম্বারের সম্মান নষ্ট করেছেন। পরে পরিষদে বিচার হলে তিনি তিন লাখ টাকা জরিমানা দেন। তার জ্বালায় আমরা পরিষদে যাওয়া বাদ দিয়েছি।
বকশিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান জুম্মান তালুকদার বলেন, বাবু সাহেব তার জীবনে অনেক অপকর্ম করেছেন। সবগুলোর মধ্যে তার একটি অপকর্ম হলো নারী কেলেঙ্কারি। তিনি বহু নারীর জীবন নষ্ট করেছেন। তার বিরুদ্ধে আমরা অনেক অভিযোগ শুনেছি। কিন্তু কখনো কিছু বলতে পারি নি। কারণ তিনি অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তার ক্ষমতার কথা শুধু বকশিগঞ্জ না পুরো জামালপুর জেলা জানে।
মাহমুদুল আলম বাবুর অবৈধ সম্পদ ও সরকারি বরাদ্দ বিতরণে অনিয়মের বিষয়টি দুদককে খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। বাবু চেয়ারম্যানের আত্মীয় ও সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য আমেনা বেগমের স্বামী আক্কাস বলেন, বাবু মুদি দোকানদার থেকে এতো টাকা কীভাবে ইনকাম করলো। এসব সম্পদ জব্দ করা দরকার। আমি দুদককে অনুরোধ করি এসব খতিয়ে দেখার জন্য এবং ব্যাংক হিসাব জব্দ করার জন্য।
এসব বিষয়ে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমান পান্না গণমাধ্যমকে বলেন, ঘটনাচক্রে আমি তার ভাই (চাচাতো ভাই)। এটা কি আমার জন্যে এখন কাল হয়ে দাঁড়াল? গত ৩-৪ বছরে আমি ৪-৫ বার শুধু এলাকায় গিয়েছি। ওর (বাবু চেয়ারম্যান) সঙ্গে তেমন সম্পর্ক নেই।
গত ১৪ জুন রাতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে জামালপুরের বকশীগঞ্জ বাজারের পাটহাটি এলাকায় বাংলা নিউজের জেলা প্রতিনিধি ও একাত্তর টিভির সাংবাদিক নাদিমের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। পরে হাসপাতালে মারা যান নাদিম। এই ঘটনায় নিহত নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম বাদী হয়ে বকশিগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলায় সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুকে প্রধান করে ২২ জনের নামে এবং অজ্ঞাতনামা ২০-২৫ জনকে আসামি করা হয়। মামলার ২য় আসামি করা হয় বাবু চেয়ারম্যানের ছেলে ফাহিম ফয়সাল রিফাতকে। এই মামলায় প্রধান আসামি মাহমুদুল আলম বাবুসহ মোট ১৪ আসামিকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।