প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৩, ০২:১৮
টেকসই উন্নয়নে শেখ হাসিনার পাঁচ প্রস্তাব
বিশ্বব্যাপী শান্তিপূর্ণ, ন্যায্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের প্রয়াসে সামাজিক ন্যায়বিচারের ওপর জোর দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্থায়ী শান্তি ও টেকসই উন্নয়নের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচারকে একমাত্র ভিত্তি আখ্যায়িত করে এই শান্তি-উন্নয়ন-ন্যায়বিচারের জন্য বিশ্ব নেতাদের কাছে পাঁচটি প্রস্তাবণা তুলে ধরেছেন তিনি। ‘ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ার্ক সামিট : সবার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার’ বিশ্ব শান্তি, ন্যায় বিচার নিয়ে বিশ্ব মোড়লদের এই বড় আসরটি গতকাল বুধবার বসেছে সুইজারল্যাণ্ডের জেনেভাতে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে একটি বৈশ্বিক জোট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টসহ সব আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এজেন্ডার কেন্দ্রে সামাজিক ন্যায়বিচারকে স্থান দেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। আমাদের সরকার জাতীয় পর্যায়ে সামাজিক অংশীজনদের সঙ্গে আরো আলোচনার মাধ্যমে এ বৈশ্বিক জোটে যোগ দেয়ার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করবে। সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর পাঁচটি প্রস্তাবনা হচ্ছে- এই জোটকে একটি মান-নির্ধারক বা দরকষাকষির ফোরাম হওয়ার পরিবর্তে একটি পরামর্শমূলক বা এডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে গড়ে তোলা, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সামাজিক ন্যায়বিচারকে এক আন্তর্জাতিক মহল দ্বার অন্য মহলের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিষয়ে এই জোটকে সতর্ক থাকা; জোটকে একটি নিয়মতান্ত্রিক বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থার আওতায় সামাজিক ন্যায়বিচারকে একটি রক্ষণবাদী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে বরং এর ব্যাপক প্রসারে ভূমিকা রাখার বিষয়ে প্রচারণা চালানো, শোভনকর্ম এবং উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করার জন্য এ জোটের বিষয়ে আইএলওর নিজস্ব অংশীজনদের ব্যাপক সমর্থন নিশ্চিত করা এবং তরুণ সমাজকে সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রবক্তা হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই জোটকে মনোযোগী হতে হবে।
আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মহাপরিচালককে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান শতাব্দীর বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী একটি নতুন সামাজিক চুক্তি সম্পাদন করা প্রয়োজন। এই সামাজিক চুক্তির মূল লক্ষ্য হতে পারে টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে সবার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশের সংবিধানে জাতির পিতা বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রকাঠামোর মূলনীতি হিসেবে বিবেচনা করে স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ নির্মাণের পথ-নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা লাভের কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে এবং একদিনে বেশ কয়েকটি আইএলও সনদে অনুস্বাক্ষর করে। বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে আমরা দুঃখী-মেহনতি মানুষের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের মূল লক্ষ্য কৃষি ও অকৃষি খাতে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থনীতির সবস্তরে শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা ও শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা। আমার সরকার ইতোমধ্যে কৃষি-শ্রম ও ব্যবসাবান্ধব হিসেবে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।
প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের সফলতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সক্ষমতা অর্জন করে একটি ন্যায়ভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই সমাজ নির্মাণের পথে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে সরকার। কোভিড-১৯ অতিমারির সময় আমরা রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের নিয়মিত বেতন পরিশোধে ৫৮৮ মিলিয়ন ডলার, দরিদ্র পরিবারসমূহে বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণের জন্য প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার এবং ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রায় ১৫৬ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করি। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলায় আমরা এক কোটি নিম্ন আয়ের পরিবারের মধ্যে স্বল্পমূল্যে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করছি। সদ্য ঘোষিত বাজেটের ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আশা করেন, আমরা এমডিজির সব লক্ষ্য পূরণ করেছি। এসডিজির লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য বহুমাত্রিক কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। ২০২৬ সালের মধ্যে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে আমাদের চূড়ান্ত উত্তরণ ঘটবে। এপ্রেক্ষিতে আমরা শ্রম খাত সম্পর্কিত ২০২১-২০২৬ সাল মেয়াদি রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করছি।
শ্রম অধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ আইএলওর দশটি মৌলিক সনদের মধ্যে আটটি অনুস্বাক্ষর করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী জানান, পেশাগত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিষয়ক নতুন দুটি মৌলিক আইএলও সনদ অনুস্বাক্ষরের বিষয়টিও আমরা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছি। পরিতাপের বিষয়, শ্রম অধিকার নিয়ে সোচ্চার কয়েকটি উন্নত দেশ এখন পর্যন্ত নিজেরা অধিকাংশ আইএলও মৌলিক সনদ অনুস্বাক্ষর করেনি। যেমন একটি বড় শিল্পোন্নত দেশ মাত্র ২টি মৌলিক সনদ অনুস্বাক্ষর করেছে। শিশু শ্রমের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণে বাংলাদেশ সম্প্রতি আইএলও সনদ ১৩৮ অনুস্বাক্ষর করেছে। ঝুঁকিপূর্ণ আটটি সেক্টরকে আমরা ‘শিশু শ্রম মুক্ত’ হিসেবে ঘোষণা করেছি। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত এক লাখ শিশু শ্রমিককে উপানুষ্ঠানিক ও কারিগরি শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম চলছে। একটি সুস্থ ও নিরাপদ আগামী প্রজন্মের স্বার্থে আমি দেশকে শিশু শ্রমের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে চাই। এসময় শ্রম আইন, শ্রম বিধিমালা, শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনাল ও শ্রম আদালত প্রতিষ্ঠা, ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড নীতিমালা’ ‘শিল্প পুলিশ’ ইউনিট গঠন, ‘প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক’ ‘জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ স্থাপনের কথা তুলে ধরেন সরকারপ্রধান। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনে এসব পরিবেশবান্ধব উদ্যোগকে আরো উৎসাহিত করবেন বলে আশা করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী জানান, বিভিন্ন শিল্প খাতে সমন্বিত দরকষাকষির মাধ্যমে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের লক্ষ্যেনীতি কাঠামো তৈরির বিষয়টি আমাদের বিবেচনাধীন রয়েছে। ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন অনলাইন করা হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের হার ২০১৩ সালের ৬০ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ৯০ শতাংশ হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্প খাতে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা গত নয় বছরে নয় গুণ বেড়েছে। শ্রমিক এবং নিয়োগকর্তাদের ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন প্রক্রিয়ার উপর নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ইপিজেড এবং নন-ইপিজেড এলাকার জন্য দুটি পৃথক টোল-ফ্রি হেল্পলাইন চালু করা হয়েছে। সেইসঙ্গে শ্রমিকদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা দানে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক শিল্প শ্রমিকদের তথ্য সংবলিত ডাটাবেজ তৈরি হচ্ছে। বক্তৃতায় নারীদের মাতৃত্বকালীন সুবিধা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম শিল্প এলাকায় কর্মজীবী নারী শ্রমিকের জন্য স্বল্পমূল্যে আবাসনের ব্যবস্থা, ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন, কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি সহিংসতা বা হয়রানির বিরুদ্ধে আমরা শূন্য-সহিষ্ণুতা, স¤প্রতি নারীদের অবৈতনিক গৃহস্থালি কর্মকাণ্ডকে জাতীয় জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে খতিয়ে দেখার নির্দেশনার বিষষ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, শ্রমিক ও তাদের পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘কেন্দ্রীয় তহবিল’ গঠন করা হয়েছে। তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য ২০২২ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ‘অ্যামপ্লয়মেন্ট ইনজুরি ইন্স্যুরেন্স স্কিম’ চালু করা হয়েছে। প্রতি বছর ২০ লাখ তরুণ-তরুণী আমাদের শ্রমবাজারে নতুনভাবে প্রবেশ করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এক কোটি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা দেশজুড়ে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছি। সেইসঙ্গে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ৩৯টি হাইটেক পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর আওতায় আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ৫২ হাজার এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দুই লাখ তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। আমরা রূপকল্প-২০৪১ অনুযায়ী ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া ও আইটি খাতের বিপুল সম্ভাবনা তুলে ধরে বলেন, বাজেটে ৯ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ও ইনোভেশন সেন্টারের মাধ্যমে ৮০ হাজার তরুণ-তরুণীকে অগ্রসর প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। দেশের সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সারকে নিবন্ধনের মাধ্যমে তাদের অর্থনীতির মূলধারায় সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
এ সময় শান্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন সরকারপ্রধান। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ঐতিহাসিক ভাষণের উদ্ধৃতি দিয়ে তুলে ধরে বক্তৃতা শেষ করেন তিনি, ‘মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার। এই শান্তির মধ্যে সারা বিশ্বের সব নর-নারীর গভীর আশা-আকাক্সক্ষা মূর্ত হয়ে রয়েছে। ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত না হলে শান্তি কখনো স্থায়ী হতে পারে না।’