প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২২, ১৪:৫২
যুক্তরাষ্ট্রের যে ঘোষণায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিল রাশিয়া
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নীতিতে কৌশলগত পরিবর্তনের আভাস দিয়েছে।
রবিবার ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে এক সফর শেষ করে পোল্যান্ডে ফিরে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল লয়েড অস্টিন খোলাখুলি বলেছেন শুধু এই যুদ্ধে পরাজয় নয়, রাশিয়ার সামরিক শক্তি চিরতরে দুর্বল করে দেওয়াই এখন যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য।
জেনারেল অস্টিনের এই বক্তব্যের পরদিন ক্ষুব্ধ রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটও এখন রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।
সোমবার রাতে রুশ টিভি চ্যানেল রাশিয়া ফার্স্টে এক সাক্ষাৎকারে লাভরভ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো জোট যদি ইউক্রেনকে ঢালাওভাবে অস্ত্র দেওয়া বন্ধ না করে তাহলে পারমাণবিক সংঘাত এবং তার জেরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘এমন ঝুঁকি এখন খুবই বাস্তব একটি সম্ভাবনা সেই ঝুঁকি এখন অনেক অনেক বেশি’। ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়া নিয়ে এতদিন যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটো জোটের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল এর উদ্দেশ্য ইউক্রেনের আত্মরক্ষায় সাহায্য করা।
কিন্তু সম্প্রতি যে ধরণের অস্ত্র ইউক্রেনকে দেওয়া হচ্ছে বা দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে তাতে ন্যাটোর সেই লক্ষ্যে পরিবর্তনের আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মুখ থেকে রবিবারের বক্তব্যের পর অনেক বিশ্লেষকই প্রশ্ন তুলছেন যুক্তরাষ্ট্রর লক্ষ্য কি ইউক্রেনের ভৌগলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সাহায্য করা নাকি এই সুযোগে রাশিয়াকে ঘায়েল করা।
বিবিসির কূটনৈতিক সংবাদদাতা জেমস ল্যান্ডেল বলছেন এমন সব অস্ত্র এখন ইউক্রেনকে দেওয়া হচ্ছে যা দিয়ে রাশিয়ার ভেতরেও হামলা চালানো যাবে।
দুদিন আগে তার একটি নমুনাও দেখা গেছে যেখানে ইউক্রেন সীমান্ত থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দূরে রাশিয়ার একটি শহরে দুটো তেলের ডিপোতে বিস্ফোরণের পর আগুন ধরে যায়, এবং ধারণা করা হচ্ছে ইউক্রেন থেকে ছোঁড়া দূরপাল্লার কামানের গোলাতেই এই অগ্নিকাণ্ড হয়েছে।
মঙ্গলবার রাতেও ইউক্রেন সীমান্ত থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে রাশিয়ার বেলগোরোদ নামের একটি শহরেও অস্ত্র গুদামে বিষ্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে।
জেমস ল্যান্ডেল বলছেন, ‘ইউক্রেনকে আত্মরক্ষায় সাহায্য করা আর রাশিয়াকে হামলার মধ্যে পার্থক্যটা ক্রমেই ধোঁয়াশে হয়ে যাচ্ছে’।
মার্কিন কর্মকর্তাদের মুখ থেকে ঘনঘন এখন শোনা যাচ্ছে - এই যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় অনিবার্য।
রাশিয়ার হুমকির তোয়াক্কা করছে না ন্যাটো
এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাশিয়ার পরাজয় নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ন্যাটো মিত্ররা যদি ইউক্রেনকে ভারী অস্ত্র-সরঞ্জাম, রসদ জুগিয়ে চলে এবং বাড়িয়ে যেতে থাকে - যে ইঙ্গিত তারা স্পষ্ট ভাবেই দিচ্ছে - তাহলে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সামনে রাস্তা কী?
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক হামলা শুরুর নির্দেশ দেওয়ার সময় পুতিন হুমকি দিয়েছিলেন, ‘কোনো পশ্চিমা শক্তি যদি এই যুদ্ধে সরাসরি মাথা গলায় তাহলে তাদের এমন পরিণতি ভোগ করতে হবে যা ইতিহাসে আগে দেখা যায়নি’।
যুক্তরাষ্ট্র যে সেই হুমকিতে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছে তার কোনো লক্ষণ নেই। রাশিয়ার সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ এড়িয়ে চললেও, রাশিয়ার ওপর যেভাবে নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে এবং ইউক্রেনকে যেভাবে ক্রমাগত অস্ত্র দেয়া হচ্ছে সেটাকে অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষকও রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে ছায়া-যুদ্ধ হিসাবে বর্ণনা করছেন।
যুক্তরাষ্ট্র একাই গত দুই মাসে ইউক্রেনকে ৩৫০ কোটি ডলারের অস্ত্র সাহায্য দিয়েছে। আরো সাতশ কোটি ডলারের অস্ত্র সাহায্য সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট বাইডেন অনুমোদন করেছেন যা দিয়ে হাওয়িতজার দূরপাল্লার কামান, মাল্টিপল রকেট লঞ্চার এবং সাঁজোয়া ড্রোনের মত অত্যাধুনিক অস্ত্র দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
এ ধরণের ‘স্পর্শকাতর’ অস্ত্র যেন ইউক্রেনকে না দেয়া হয় তা নিয়ে রাশিয়া এ মাসের মাঝামাঝি লিখিতভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং বেশ কয়েকটি ন্যাটো দেশকে সাবধান করে। ঐ চিঠিতে সতর্ক করা হয় ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর’ এসব অস্ত্র ইউক্রেনে পাঠালে ‘অজানা পরিণতি’ ভোগ করতে হতে পারে।
এই হুমকিতেও যে যুক্তরাষ্ট্র কান দিয়েছে তার কোনো লক্ষণ নেই। কারণ রাশিয়ার ঐ চিঠি পাওয়ার ১০ দিনের মাথায় ইউক্রেনকে সমন্বিত-ভাবে অস্ত্র সাহায্য দেওয়া নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার জার্মানিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৪০টি দেশের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের ডেকে এনে এক বৈঠক শুরু করেছে।
এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ইউক্রেন যুদ্ধের পরের ধাপে দেশটিকে কীভাবে আরও দীর্ঘমেয়াদে এবং আরও বেশি সামরিক সহায়তা দেয়া যায়।
জার্মানি বহু বছর ধরে কোন সংঘাত-পূর্ণ অঞ্চলে ভারী অস্ত্র না পাঠানোর নীতি অনুসরণ করতো। তবে ইউক্রেনের বেলায় একই নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে জার্মানি বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে। এখন তারা সেখান থেকে সরে আসতে যাচ্ছে, জার্মান সরকার এই প্রথম ইউক্রেনের কাছে বিমান-বিধ্বংসী ট্যাংক বিক্রির বিষয়টি অনুমোদন করেছে। মঙ্গলবার জার্মানি বলেছে তারা রাডারযুক্ত কয়েক ডজন ট্যাংক দেবে যা দিয়ে বিমান ধ্বংস করা যায়।
ন্যাটোর অন্য দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স, তারা ইতোমধ্যে ইউক্রেনকে ভারী সামরিক সাজ-সরজ্ঞাম দেয়া শুরু করেছে। ফরাসিরা দিচ্ছে কিছু সিজার কামান, যেগুলোর রেঞ্জ হচ্ছে প্রায় ৪০ কিলোমিটার। আর ব্রিটেন দিচ্ছে স্টারস্ট্রেক এন্টি এয়ারক্রাফট ক্ষেপণাস্ত্র এবং ট্যাংক।
এই বৈঠক শুরুর দিন অর্থাৎ সোমবারই ব্রিটেন ঘোষণা করেছে তারা স্টারট্রেক বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত সাঁজোয়া গাড়ি পাঠাবে ইউক্রেনে।
কতদূর যেতে পারে রাশিয়া?
ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটো জোটকে নিরস্ত করতে কতদূর যেতে পারে রাশিয়া? বিকল্প কী তাদের সামনে?
রাশিয়া একাধিকবার হুমকি দিয়েছে বিদেশ থেকে যেসব অস্ত্র ইউক্রেনে ঢুকছে সেগুলো তাদের বৈধ টার্গেট। তবে এখন পর্যন্ত ন্যাটোর পাঠানো অস্ত্র বহরে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো হামলা রাশিয়া করেনি।
ন্যাটো অস্ত্রের চালান পূর্ব এবং দক্ষিণের রণাঙ্গনে আসা ঠেকাতে সম্প্রতি ইউক্রেনের পশ্চিমের রেল নেটওয়ার্কে রাশিয়া বেশ কটি হামলা করেছে। অন্তটি ছয়টি স্টেশন এবং জংশন বিধ্বস্ত হয়েছে।
তবে, ভারি অনেক অস্ত্র যে এরই মধ্যে ঢুকে গেছে তার প্রমাণ রাশিয়ার অনেকটা ভেতরেও এখন ইউক্রেন থেকে ছোঁড়া গোলা গিয়ে পড়ছে।
সিআইএর রাশিয়া অ্যানালাইসিস বিভাগের সাবেক পরিচালক জর্জ বিব ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকাকে বলেন, ‘রাশিয়া ইউক্রেনের ভেতর কিছু অস্ত্র গুদামে টার্গেট করেছে, কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো তারা কি ইউক্রেনের সীমানার বাইরে এমন অস্ত্র কনভয়ের ওপর হামলা চালানোর ঝুঁকি নেবে কিনা?’
বিব মনে করেন এ দফার লড়াইতেও যদি রুশ সৈন্যরা চাপে পড়ে তাহলে হয়তো ন্যাটোর কোনো দেশের ভেতরেই এমন অস্ত্রের চালানের ওপর রুশ হামলার ঝুঁকি বাড়বে। পোল্যান্ডের সীমান্তে তেমন হামলার বড় ঝুঁকি রয়েছে।
‘মার্কিন এবং পশ্চিমা দেশগুলোর অনেকে এখন মনে করছেন আমরা নির্ভয়ে অবাধে ইচ্ছামত ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে যেতে পারি এবং রাশিয়া কিছুই করতে পারবে না... আর রাশিয়া বার বার বলার চেষ্টা করছে তোমাদের এতটা নিশ্চিন্ত হওয়া চলবে না’।
পারমাণবিক সংঘাতের যে হুমকি রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিয়েছেন তাকে যুক্তরাষ্ট্র কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে? রাশিয়া কি সেই ঝুঁকি নেবে?
সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস এ মাসের গোড়ার দিকে মন্তব্য করেন ‘সে সম্ভাবনা খুবই কম’, কিন্তু ঝুঁকি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা উচিৎ হবেনা। নিই ইয়র্ক টাইমস বার্নসকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, ‘পুতিন যে চাপে পড়েছেন, তার সেনাবাহিনী যে চাপে পড়েছে, তাতে এমন ঝুঁকি হালকাভাবে নেয়া ঠিক হবেনা’।
নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখছে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা কিছু সম্ভাবনার কথা মাথায় রাখছেন:
‘সামরিক সাফল্যের অভাবে হতাশ হয়ে পুতিন ভয় দেখানোর জন্য পরীক্ষামুলক একটি পারমাণবিক বোমা হয়তো ফাটাতে পারেন। সেটা হতে পারে কৃষ্ণ সাগরে অথবা জনমানব শূন্য কোনো এলাকায়। বার্তা হবে- পশ্চিমারা তোমরা আর সামনে এগিও না’।
কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সমর-বিদ্যা বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী মনে করেন না যুদ্ধে রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের পথে যাবে।
‘তাদের নিজেদের বিপদের কথা ভেবেই রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না। লাভরভ সম্প্রতি ভারতে গিয়েও এমনকি স্বল্প মাত্রার ট্যাকটিকাল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনাও নাকচ করে এসেছেন। আমার মনে হয় পশ্চিমা সরকারগুলোও তা জানে’।
তাহলে ন্যাটোর চাপ ঠেকাতে রাশিয়ার সামনে উপায় কী? কোন কৌশল তারা নিতে পারে?
ড. আলী মনে করেন পূর্বের ডনবাস এবং দক্ষিণের মারিওপোল থেকে ওডেসা পর্যন্ত রুশ ভাষাভাষী অঞ্চল দখল এবং নিয়ন্ত্রণে রাখার যে ‘সীমিত লক্ষ্য’ এখন রাশিয়া নিয়েছে মনে হচ্ছে সেটা তারা তাদের ‘কনভেনশনাল অস্ত্র’ দিয়েই অর্জন করতে পারবে।
‘তবে তাদের হাত সময় খুব কম। দুই তিন সপ্তাহের মধ্যে করতে হবে’। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি একটি নিয়ন্ত্রণ রেখা তৈরি হয়ে গেলে দুই দেশের সৈন্যরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে থাকবে। তারপর একটা স্থিতাবস্থার সূচনা হতে পারে’।
সূত্র: বিবিসি, দেশ রূপান্তর