শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে

প্রকাশ : ২৮ মে ২০২২, ১২:০৮

মাতৃমৃত্যু কমলেও নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ায় বাড়ছে জটিলতা

মাতৃমৃত্যু কমলেও নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ায় বাড়ছে জটিলতা
অনলাইন ডেস্ক

পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি শব্দ ‘মা’। একজন মা ছাড়া কোনো মানুষের পৃথিবীতে আগমন এবং তার অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। তবে একটি শিশু জন্মদানে একজন মাকে অনেক কষ্ট এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। একটি বড় সময় নিজের গর্ভে রেখেই একটি জীবনকে লালন করেন মা। এই গর্ভধারণের সময়, প্রসব এবং প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়েদের দরকার নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ। নিয়মিত পরামর্শ গ্রহণ জটিলতা তৈরির শঙ্কা কমায়।

জাতিসংঘ এবং ডব্লিউএইচও’র তথ্য অনুসারে, শিশু জন্ম দিতে গিয়ে প্রতিদিন প্রায় আটশ নারী মৃত্যুবরণ করেন। ২০১৩ সালে বিশ্বে দুই লাখ ৮৯ হাজার নারী গর্ভাবস্থায় এবং প্রসবের জটিলতার কারণে মারা যান। প্রতিবছর অন্তত সাত মিলিয়ন নারী প্রসব পরবর্তী গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। এছাড়া আরও ৫০ মিলিয়ন নারী প্রসবের পর নানারকম স্বাস্থ্য জটিলতায় ভোগেন। বাংলাদেশে প্রতিবছর ১২ হাজার নারী গর্ভধারণ ও প্রসবের জটিলতার কারণে মারা যান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতে, বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে মাতৃমৃত্যু কমছে। সংস্থাটি বলছে, ২০২০ সালে যেখানে ৮৮৪ জন মায়ের মৃত্যু হয়, সেখানে গত বছর তা কমে ৭৮৮ জনে নেমেছে। এছাড়াও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, ২০১০ সালে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যু ছিল ১৯৪ জন। এক দশকে তা কমে ১৬৫ জনে নেমেছে। তবে গ্রামে এখনো এই হার ১৯১ জন, শহরে যা ১২৩ জন।

এদিকে গর্ভবতী নারীদের নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ গ্রহণ বাংলাদেশে খুব একটা সন্তোষজনক নয়। এর ফলে গর্ভধারণের সময়, প্রসব এবং প্রসব পরবর্তী সময়ে জটিলতার আশঙ্কা বাড়ছে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে জানা যায়, স্বাভাবিক সময়েই জনবল ও অবকাঠামোগত নানা সংকট ও চ্যালেঞ্জ থাকে। এর মধ্যে প্রায় দুই বছর করোনা মহামারির কারণে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা আরও ব্যাহত হয়েছে। বাংলাদেশে গর্ভবতী নারীদের চারদফা সেবা গ্রহণের মধ্যে প্রসব পূর্ব সেবা নেওয়ার হার ২০২০ সালে প্রথমবার সেবা নেওয়ার হার ২৬ শতাংশ কম ছিল। দ্বিতীয়বার ২৫ শতাংশ, তৃতীয়বার ২৬ শতাংশ এবং চতুর্থবার ২৪ শতাংশ কম ছিল। এরপর ২০২১ সালে এসে প্রথমবার সেবা নেওয়ার হার বেড়েছে। তবে পরের তিন দফায় আগের মতোই কম। গত বছর প্রথমবার সেবা নেন ১২ লাখ ১৫ হাজার প্রসূতি নারী। সেখানে পরের তিন দফায় কমে তা নামে পাঁচ লাখেরও নিচে।

স্বাস্থ্যবিদরা জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ৭০ শতাংশে নিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ সরকারিতে এবং ৮৫ শতাংশই বেসরকারি হাসপাতালে হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) আরও জানায়, দেশে প্রান্তিক পর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ধাত্রীবিদ্যার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। কিন্তু সেগুলো ঠিকঠাক জোরদার নেই। দু-একটি ছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে সন্তান প্রসবের তেমন নজির নেই। এছাড়া সরকারি হাসপাতালে নানা ভোগান্তির ফলে বড় একটি অংশ বেসরকারিতে চলে যাচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালে সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদান বাড়ছে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু) ডা. মাহমুদুর রহমান জানান, গর্ভবতী নারীর প্রসবপূর্ব সেবা ‘অ্যান্টিন্যাটাল কেয়ার’ (এএনসি) এবং প্রসব পরবর্তী সেবা ‘পোস্টন্যাটাল কেয়ার’ (পিএনসি) নেওয়া পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে গর্ভের সন্তান চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকে। মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি কম থাকে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কাজ গর্ভবতীদের স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে নিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করা, প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া। কিন্তু অবকাঠামো ও জনবলের চরম ঘাটতি থাকায় তা শতভাগ সম্ভব হচ্ছে না। সারা দেশে পরিবার কল্যাণ সহকারীর (এফডব্লিউএ) পদের সংখ্য সাড়ে ২৩ হাজার। এরমধ্যে এক তৃতীংশ ঘাটতি রয়েছে। মাতৃসেবা ব্যাহত হওয়ার এটিই প্রধান কারণ।

ডা. মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, দেশে ১৯৭৪ সালে যখন জনসংখ্যা সাত কোটি ছিল তখন এই কাজের জন্য পরিবার কল্যাণ সহকারীর ২৩ হাজার ৫০০ পদ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু বর্তমানে জনসংখ্যা ১৭ কোটি হলেও সেই পদই রয়েছে, যা এখন ৪৭ হাজার হওয়ার কথা। আবার যে পদ আছে সেখানে খালি সাড়ে ছয় হাজার।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্যে আরও জানা যায়, এখন পর্যন্ত ১০ শতাংশ সনাতন ও ৫২ শতাংশ আধুনিক পদ্ধতি মিলে ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ দম্পতি স্বাস্থ্যসেবার আওতায় এসেছেন। এর মধ্যে স্থায়ী আছে মাত্র ৯ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা ছিল আগামী বছরের মাঝামাঝিতে এটাকে ২০ শতাংশে উন্নীত করা। কিন্তু জনবল না থাকায় লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছা কঠিন হচ্ছে।

অবসটেট্রিক্যাল গাইনোকলোজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা বলেন, দেশে মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ বাল্যবিয়ে, বিশ বছর বয়সের আগেই সন্তান নেওয়া। এ ছাড়া প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি, বিলম্বিত প্রসব ও ঠিকমতো প্রসব করতে না পারায় ইনফেকশন মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ। অন্যদিকে কম ওজন নিয়ে জন্ম, প্রি-ম্যাচিউরড, জন্মের পরপর শ্বাস না নেওয়া ও নাভিতে ইনফেকশনের কারণে নবজাতকের মৃত্যু হয়। এছাড়া বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী বেড়ে গেছে সিজারিয়ান ডেলিভারি। বিপরীতে উদ্বেগজনক হারে কমে গেছে ভ্যাজাইনা ডেলিভারি বা স্বাভাবিক উপায়ে সন্তান প্রসব। সিজারিয়ান ডেলিভারি কিছু উপকার থাকলেও এর ক্ষতির দিক অনেক বেশি। এছাড়া মাতৃ ও শিশু মৃত্যু কমাতে হলে এ খাতে দক্ষ জনবল বড়ানো জরুরি।

সূত্র: জাগো নিউজ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়