প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৪, ২১:৪৫
যে পাঁচ দিনের কথা ভুলবে না নারায়ণগঞ্জবাসী
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যেন নারকীয় তাণ্ডব চলেছে প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত জেলা নারায়ণগঞ্জে। প্রথম কয়েকদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ১৮ জুলাই থেকে অশান্ত হয়ে ওঠে নারায়ণগঞ্জ। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষের পাশাপাশি চলতে থাকে ব্যাপক নাশকতা-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট। জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে চলেছে নজিরবিহীন তাণ্ডব।
মূলত কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে উঠা অহিংস আন্দোলনটি হঠাৎ করেই সহিংস হয়ে ওঠে। এতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ ও পুলিশ-আনসারসহ অনেকে হতাহত হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষাসহ দেশবাসীর জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং অরাজকতা নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার গত শনিবার (২০ জুলাই) কারফিউ দেয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
বর্তমানে দেশের অন্যান্য জেলার মতো নারায়ণগঞ্জেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের জেরে ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতচিহ্ন এখনো সাধারণ মানুষের চোখের সামনে ভাসছে। বুধবার (২৪ জুলাই) কারফিউ শিথিল থাকায় অনেকটা স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফিরেছে মানুষজন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সঙ্গে বাড়ছে দ্রুত কারফিউ তুলে নেওয়ার দাবি।
এদিকে কয়েকদিন ধরে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকার পর এখন তা ধীরে ধীরে সচল হতে শুরু করেছে। অনলাইন গণমাধ্যমের নিয়মিত পাঠকদের জন্য কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে নিকটবর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জে ঘটে যাওয়া চিত্র তুলে ধরা হলো।
১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার
পুলিশের গাড়ি ভাঙে অজ্ঞাতরা। এতে উত্তপ্ত হতে শুরু করে নারায়ণগঞ্জ। এর আগের কয়েকদিনের মতো এদিনও বেলা ১১টায় শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়া ও দুই নম্বর রেলগেইটে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী জড়ো হন আন্দোলনকারীরা। দুপুর ১টার দিকে চাষাঢ়ায় পুলিশের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করা হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় পুলিশ আন্দোলনরতদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে।
অন্যদিকে, আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। বিকাল পর্যন্ত চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। তবে আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্যতম সমন্বয়ক ফারহানা মুনা বলেন, কে বা কারা পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করেছে তা আমরা জানি না। তারা আমাদের কেউ নন, এমনকি তাদেরকে আমরা কেউ চিনিও না। আমরা শুরু থেকেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বলে আসছি। ওই অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিষয়ে সেখানে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের আমিসহ কয়েকজন অবগত করতে এগিয়ে যাওয়া মাত্রই পুলিশ আমাদের ওপর হামলা করে। আমাদের কত জন এদিন আহত হয়েছেন, তা বলা যাচ্ছে না।
তবে এদিন সন্ধ্যার পর থেকেই ব্যাপক আকারে নাশকতা শুরু করে দুষ্কৃতকারীরা। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় জেলা পিবিআই কার্যালয়, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, শহরের দুই নম্বর রেলগেটের পুলিশ বক্স, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের অফিসে। এসব সত্য খবরের পাশাপাশি মুখে মুখে ছড়িয়ে দেওয়া হয় আরও অনেক গুজব। কার্যত আতঙ্ক, আগুন, ভয় আর গুজবের জেলায় পরিণত হয় পুরো জেলা।
১৯ জুলাই, শুক্রবার
শুক্রবার সকাল থেকেই জেলাজুড়ে বিরাজ করছিল থমথমে অবস্থা। জেলার সাইনবোর্ড, চিটাগাংরোড, জালকুড়ি, ভূঁইগড়, চাষাঢ়াসহ বেশকিছু স্পটে দলবেঁধে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। কোথাও সড়ক বিভাজকের কিছু অংশ তুলে, কোথাও গাছ ফেলে সড়কে অবরোধ তৈরি করা হয়। অনেকের হাতে রড, লাঠি, ইট ছিল। সেইসাথে আগের রাতে আগুন দেওয়া পাসপোর্ট অফিস, পিবিআই কার্যালয়ে সমানতালে চালাতে থাকে লুটপাট।
জুম্মার নামাজের পরপর ভূঁইগড় পার হয়ে পুলিশের বেশ কয়েকটি গাড়ি সাইনবোর্ডের দিকে মাইকিং করতে করতে ধীরগতিতে এগোতে থাকে। এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বিক্ষোভকারীদের নিরাপদ অবস্থানে চলে যেতে বলা হলেও তারা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকে। পুলিশও রাবার বুলেট ও টিয়ারসেল ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বিকাল ৪টা পর্যন্ত থেমে থেমে চলে সংঘর্ষ।
অন্যদিকে শহরের ডিআইটি এলাকাতেও দুপুরের পরে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এসব ঘটনায় পুলিশ সদস্য, পথচারীসহ আহতের সংখ্যা দাঁড়ায় শতাধিকে।
এদিন রাতে আগের রাতের চেয়েও আরও বেশি হিংস্রতা প্রদর্শন করে দুর্বৃত্তরা। ফতুল্লায় অবস্থিত নাসিম ওসমান মেমোরিয়াল পার্ক (নম পার্ক), শহরে অবস্থিত আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার, নারায়ণগঞ্জ ক্লাব, জালকুড়ির যুব উন্নয়ন কার্যালয়, রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান এসবি গার্মেন্টসহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। জালকুড়িতে ডিপোতে হামলা করে ঢাকা- নারায়ণগঞ্জ রুটের শীতল পরিবহনের ২৬টি বাসে আগুন দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে পিকআপ, প্রাইভেটকারসহ যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
২০ জুলাই, শনিবার
এদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়। বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনীও। তবুও নারায়ণগঞ্জে দমানো যায়নি দুর্বৃত্তদের। টায়ার জ্বালিয়ে, গাছ ফেলে সড়কে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার পাশাপাশি দুপুরে চিটাগাংরোড ও সাইনবোর্ড এলাকায় জড়ো হতে শুরু করে তারা।
এক পর্যায়ে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। শিমরাইলের একটি মার্কেটে আগুন দেয় বিক্ষোভকারীরা৷ এতে ভবনটিতে আটকা পড়েন ৩৭ জন পুলিশ সদস্য। পরবর্তীতে হেলিকপ্টার দিয়ে ৩৭ পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করে র্যাব। এদিন যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত ও গুলিবিদ্ধসহ প্রায় ২০০ জন আহত হন।
২১ জুলাই, রোববার
এদিনও উত্তপ্ত ছিল নারায়ণগঞ্জ। বিশেষত ঢাকার প্রবেশমুখ চিটাগাংরোড ও সাইনবোর্ডে এদিনও সকাল থেকে বিক্ষোভকারীদের অবস্থান ছিল চোখে পড়ার মতো। দুপুরে যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু করে এসব এলাকায়। দফায় দফায় চলা সংঘর্ষে কমপক্ষে একজন নিহত ও শতাধিক আহতের খবর পাওয়া যায়। সন্ধ্যা নাগাদ বিক্ষোভকারীরা পিছু হটে। রাতে সেনাবাহিনী পুরো এলাকার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নেয়। ২২ জুলাই, সোমবার
সেনাবাহিনীর শক্ত অবস্থানে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে। জনমনে ভীতি কাটতে শুরু করে। কারফিউয়ের শিথিলতার সময়ে জরুরি কেনাকাটা সারতে অনেকেই ঘর থেকে বের হতে শুরু করেন।
নিহত যারা
গত কয়েকদিনের সংঘর্ষে নারায়ণগঞ্জে কমপক্ষে ১৫ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন- কুষ্টিয়ার কুমারখালি থানার চর জগন্নাথপুর গ্রামের ওহাব মণ্ডলের ছেলে মো. সেলিম মণ্ডল (১৯), একই এলাকার মৃত মো. সাবের বিশ্বাসের ছেলে মো. আ. ছালাম (২২) ও সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার কাভুরা গ্রামের তোফলেসুর রহমানের ছেলে মো. সোহেল আহমেদ (২১)।
শনিবার বিকেলে শিমরাইলে একটি মার্কেটে দুষ্কৃতকারীদের দেওয়া আগুনে পুড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এছাড়া সংঘর্ষে নিহত আরও যাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে, তারা হলেন- সিদ্ধিরগঞ্জের মাছ ব্যবসায়ী মো. মিলন (৩৬), ফল ব্যবসায়ী সজিব (২১), কিশোর আকাশ (১৬), মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মেহেদী (২১), সিদ্ধিরগঞ্জের হীরাঝিল হোটেলের স্টাফ শাহীন (২৩), চাঁদপুরের মতলবের আলাউদ্দিন (৩৫), সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদীর সুমাইয়া (২২), একই এলাকার হৃদয় (২৫) সজল (২২), শাহিন (২৩), মিনারুল ইসলাম (২৫), রিয়া (৬)।
মামলা ও গ্রেপ্তারের আদ্যোপান্ত
নাশকতা-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের নির্দেশদাতা, ইন্ধনদাতা, মূল হোতাদের ধরতে নিজেদের অঙ্গীকারের কথা ব্যক্ত করেছেন জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল। ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নাশকতা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের দায়ে নয়টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সোমবার (২২ জুলাই) রাতে মামলাগুলো দায়ের করা হয়। এসব মামলার আসামি করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা, মহানগর, থানা ও ওয়ার্ড বিএনপির নেতাকর্মীদের। মামলায় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, আরও মামলা হবে বলেও জানানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত পুরো জেলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩০৯ জনকে। বুধবার (২৪ জুলাই) দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) গোলাম মোস্তফা রাসেল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এই তথ্য জানান।
গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, সহিংসতা, নাশকতার সাথে জড়িতদের ধরতে জেলাজুড়ে চিরুনি অভিযান চলছে। কোনো সাধারণ ছাত্র এসব নাশকতায় জড়িত ছিল না। দুষ্কৃতিকারীরা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। ১৮-১৯ জুলাই বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি স্থাপনা পুড়িয়েছে তারা। শুরু থেকেই তাদের প্রতিরোধ করে আসছি। তাণ্ডব চালাতে বাইরে থেকে লোক ভাড়া করে আনা হয়েছিলো। গ্রেপ্তারকৃতরা নাশকতার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। ফতুল্লা থানা যুবদল নেতা মামুন ও জামায়াত নেতা মাসুদ মেম্বারের নেতৃত্বে সহিংসতা- নাশকতা চালানো হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে তারা। তাদের প্রধান নির্দেশদাতা ছিলেন জেলা বিএনপির সভাপতি গিয়াসউদ্দিন। এছাড়া ছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) কাউন্সিলর ইকবাল হোসেন, জেলা যুবদলের সদস্যসচিব মশিউর রহমান রনি ও মহানগর যুবদলের আহ্বায়ক মনিরুল আলম সজল।
অভিযান চলমান থাকবে জানিয়ে পুলিশ সুপার আরও বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেছে দুষ্কৃতিকারীরা। নাশকতা চালানো বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির মুখোমুখি করা হবে।