প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০২৩, ০৫:৫৩
বন্যায় ক্ষতবিক্ষত কক্সবাজার, ১৪ জনের মৃত্যু
অবশেষে বন্ধ হয়েছে বৃষ্টিপাত। ফলে নদীতে কমে এসেছে বৃষ্টি ও বানের জল। পানি কমছে চকরিয়া-পেকুয়ার ১৯টি ইউনিয়ন ও রামুসহ প্লাবিত নিম্নাঞ্চল থেকে। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠছে মহাসড়ক, উপসড়ক, কাঁচারাস্তা ও বাঁধের ক্ষতচিহ্ন।
কালভার্ট ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে অনেক এলাকা। ঢল আর জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাওয়া গ্রামীণ জনপদে নষ্ট হয়েছে কৃষকের বীজতলা, ফসলের মাঠ, মাছের ঘের ও বেড়িবাঁধ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ক্ষতির মুখে পড়েছে রেললাইন।
বৃষ্টিতে পাহাড়ধস, সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে, সাপের কামড় আর পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে শিশুসহ ১৪ জনের। পানি নামার পর আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ঘরে ফেরা মানুষগুলো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সংকটে পড়েছেন। যদিও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেই ত্রাণ দুর্গতদের কাছে পৌঁছেনি বলে দাবি ভুক্তভোগীদের। চারদিন পর কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানচলাচলও স্বাভাবিক হয়েছে।
এদিকে, শুক্রবার (১১ আগস্ট) সকালে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে আসছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান।
জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যমতে, জেলায় ৬০টি ইউনিয়নে চার লাখ ৭৯ হাজার ৫০৩ জন বন্যার কবলে পড়েন। চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় ১৬২টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নেন। এসব মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের পাশাপাশি ৩৭ হাজার ৫০০টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়। মজুত রয়েছে আরও ৫০ হাজার। এসময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৯ কিলোমিটার সড়ক-উপসড়ক। এখনো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে পেকুয়ার ছয়টি এবং চকরিয়ার ১৩টি ইউনিয়ন।
প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক কোটি সাড়ে ৪০ লাখ টাকা। পানি কমে গেলে চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী মনজুুর আলম বলেন, বন্যার সময় দুর্গতের মধ্যে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা চ্যালেঞ্জ। আমরা এ পর্যন্ত ৩৭ হাজার ৫০০টি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ২০০টি পানিসহ জেরিকেন এবং ৫০০০ লিটার পানি সরবরাহ করেছি। আরও ৫০ হাজার ট্যাবলেট আমাদের মজুত রয়েছে। কক্সবাজারের পাশাপাশি বান্দরবানকেও আমাদের সাপোর্ট দিতে হচ্ছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে পেকুয়া ও চকরিয়ায় পাঁচ শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে পেকুয়া উপজেলায় তিনজন ও চকরিয়ায় দুজনের মরদেহ পাওয়া যায়। এছাড়া বানের পানি নেমে গেলে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়া সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে গ্যাসের বিষক্রিয়ায় বাবা ও তার দুই ছেলের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন চকরিয়ার বিএমচর ইউনিয়নের দক্ষিণ বহদ্দারকাটা বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন (৭০), তার দুই ছেলে শাহাদাত হোসেন( ৪৫) ও শহিদুল ইসলাম (২২)।
নিহত পাঁচ শিশু হলো পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের নরুল আলমের মেয়ে তাহিদা বেগম (১০) ও ছেলে আমির হোছাইন (৭), তাদের নিকটাত্মীয় ছাবের আহমদের মেয়ে হুমাইরা বেগম (৮) ও চকরিয়ার বদরখালী ইউনিয়নের ভেরুয়াখালীপাড়ার মো. এমরানের ছেলে মো. জিশান (৯)। তবে খুটাখালী থেকে উদ্ধার হওয়া শিশুর পরিচয় এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ।
পেকুয়ার ইউএনও পূর্বিতা চাকমা প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বলেন, বুধবার বিকেলে তিন শিশু সাহেবখালী খালের পাশে তাদের ফুপুর বাড়িতে বেড়াতে যায়। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে নিখোঁজ হয়। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে ওই খালে তাদের মরদেহ ভেসে ওঠে।
চকরিয়া থানার ওসি জাবেদ মাহমুদ জানান, বৃহস্পতিবার সকালে বদরখালীর ভেরুয়াখালীর নতুন বাজারের পাশে এবং দুপুরে চকরিয়ার খুটাখালী ইউনিয়নের মহেশখালী খালে অর্ধগলিত আরও একজনের মরদেহ উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ডুবে থাকা পুরো এলাকা থেকে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে পানি। এর সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠছে বিধ্বস্ত রাস্তাঘাট, কালভার্ট, কৃষকের নষ্ট বীজতলা আর ফসলের মাঠের ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন।
লক্ষ্যারচরের আব্দুল গফুর বলেন, ‘চারদিন ৪-৫ ফুট পানিতে বন্দি ছিলাম। আমার চাষের সবকিছু ধ্বংস হয়েছে। যে ক্ষতি হয়েছে তা কিভাবে পূরণ করবো তা ভাবতে পারছি না। সরকারি সহযোগিতা ছাড়া চারদিকে সব অন্ধকার দেখছি।’
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় চকরিয়া-পেকুয়ায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে দাবি করে স্থানীয় সংসদ সদস্য জাফর আলম বলেন, ‘গত ৫০ বছরে এমন বন্যা দেখেনি। বন্যায় চিংড়ির ঘের, ক্ষেত-খামার, বাগান, ঘরবাড়ি থেকে শুরু রাস্তাঘাট, সডক-মহাসড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন।’
এখনো জমে থাকা পানি নেমে গেলে চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা যাবে বলে জানিয়েছেন চকরিয়ার ইউএনও জেপি দেওয়ান।
অন্যদিকে, বন্যায় তিনদিন বন্ধ থাকার পর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে বলে জানিয়েছে বাস ও পরিবহন সংগঠন। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে মহাসড়কসহ আঞ্চলিক সড়কগুলোতে যান চলাচল শুরু হয়। কক্সবাজারের ২০টি পরিবহনের অন্তত ৬০০ বাস চলাচল করে এ সড়কে।
চারদিনের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন। চকরিয়া এবং চট্টগ্রামের সাতকানিয়া সংলগ্ন এলাকায় রেললাইনটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান জানান, বন্যায় চকরিয়া, পেকুয়া, রামু এবং চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও চন্দনাইশের বেশকিছু এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত হিসাব করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
বন্যায় রেললাইনের পাথর, মাটি ও বাঁধ ভেসে গেছে। কিছু অংশে রেললাইন হেলেও পড়েছে। এ ক্ষতির কারণে প্রকল্প শেষ হতে দেরি হতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানান তিনি।
কক্সবাজারের এডিসি (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ জানান, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারে ৬০ ইউনিয়নে চার লাখ ৮০ হাজার মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ভূমিধস ও পানিতে ডুবে মারা গেছেন ১৪ জন। বন্যা দুর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের ১৫ লাখ ৭৫ হাজার নগদ টাকা ও ১০৩ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। বন্যায় প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি দুই কোটি টাকা।